আফসানা বেলার গদ্য ‘কবিতার কথা’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৯

ভালো কবিতার অনেক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি হচ্ছে, তাকে অনেক ভাবে `পাঠ` করা যায়। অনেক সময় বিভিন্ন জনের কাছে একই কবিতা পরস্পর বিপরীত অর্থ নিয়েও হাজির হতে পারে। আর কবি নিজে যদি কবিতার অর্থ বলে দেন সেটি বাতিলের এখতিয়ারও রয়ে গেছে পাঠকের।

পাঠক বা পাঠক পরম্পরাই অর্থের নির্মাতা। আর শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রে ‘সঠিক অর্থ’র ধারণা উবে গেছে সেই কবেই। সঠিক ব্যাখা বলেও আজকাল কিছু আছে বলে মনে করা হয় না। আছে বিবিধ ব্যাখা। কালই প্রতিটি টেক্সটের নতুন ব্যাখার উপাদান হাজির করে।

জ্ঞানের নানা শাখার নির্যাস দিয়েও কাব্য ব্যাখা করা যায়, আর কাব্য শুধু অনুভূতিই ধারণ করে তা নয়, ধারণ কিরে চিন্তাও। অনুভূতিও মনে হয়, চিন্তা কাঠামোর মধ্যেই ফাংসন করে। তাই কবিতা যা আপাতত দৃষ্টিতে অনুভূতির রূপায়ন বলে  মনে হয়, তাতে চিন্তার চাপও থাকে, মতাদর্শের বহিঃপ্রকাশও থাকে।

আর আড়ালে আবডালে যা বলতে চাই বা চাই না তা-ও থাকে। দক্ষ সমালোচক কবিতার বা সাহিত্যের ভেতরের লুকানো কোডও তুলে আনেন, প্রচলিত ব্যাখ্যা ভেঙে ফেলেন। যাই হোক, ইয়েটসের Easter 1916 কবিতাটি ইতিহাসের প্রতি কবির ব্যক্তিগত সাড়া বা প্রতিক্রিয়া।

মজা হচ্ছে, কবিতাটিকে যেমন আইরিশ জাতিয়তাবাদী কবিতা হিশেবে পাঠ করা যায়, আবার এটিকে আইরিশ জাতিয়তাবাদ বিরোধী কবিতা হিশেবেও পড়া যায়। ইয়েটসের কবিতায় ইতিহাস তার প্রায় কনক্রিট চেহারা নিয়ে হাজির থাকে, আর জীবনানন্দের কবিতায় ইতিহাস থাকে বিমূর্ত চিন্তা বা উপলব্ধি রূপে কাব্যস্রোতের নীচে।

আইরিশ বিপ্লবীদের প্রতি ইয়েটসের মনোভান সর্বদা সরল সমর্থন বা বিরোধীতা আকারে চলেনি। এই Ambiguity হয়তো ইয়েটসের ইতিহাস ব্যখ্যার শক্তিই আসলে। ইতিহাস তো নিজে কথা কয় না। ইতিহাসকে ইয়েটসের নিজের ভাবনা অনুযায়ী বা চকিত অনুভব অনুযায়ী কথা কওয়ায়।

পার্স, কনোলি, ম্যাকব্রাইডরা আইরিশ মহান বিপ্লবী। ইয়েটস তাদের নাম উচ্চারণ করেন একের পর এক। কিন্তু তারা কবিতায় হাজির হন যতটা না বিপ্লবী পরিচয়ে, তারও বেশি ব্যক্তিগত পরিচয়ে। কেউবা কবি, কেউবা স্কুল শিক্ষক, কেউবা কবির প্রেয়সীর স্বামী রূপে। কবিতাটি আবার এদেরকে রূপান্তরিত মানুষ হিসেবেও দেখায়, ম্যাকব্রাইডের প্রতি ইয়েটসের ঘৃণা রূপান্তরিত হয় কিছুটা সমীহে।

বিপ্লব, মৃত্যু সব পাল্টে দেয়। মৃত্যু জীবনকে মহিমা দেয়। ইয়েটস একফাঁকে কিন্তু ইংল্যান্ডের উপর আস্থার কথা বলেন। এই লাইনটিকে কোনো পাঠক ভরকেন্দ্র ধরলে পুরো কবিতার অর্থান্তর ঘটবে। যা ছিল প্রশংসা ও সমীহ, তা হয়ে উঠবে কটাক্ষ, কিছুটা শ্লেষ। যে কবিতাকে বিপ্লবের প্রশংসা হিশেবে পাঠ করবেন, কোনো এক ক্ষুদ্র সূত্রের উপলক্ষে একই কবিতাকে পাঠ করতে পারবেন বিপ্লববিরোধীতার অবচেতন বাসনা হিসেবেও। হয়তো এভাবেই রচিত হয় শক্তিমান কবিতা।

 

লেখক: কবি