আপসকামী আ. লীগ এবং মন খারাপের কথামালা
স্বকৃত নোমানপ্রকাশিত : নভেম্বর ০৪, ২০১৮
আওয়ামী লীগের সঙ্গে অসাম্প্রদায়িকতার একটা ঐতিহাসিক সম্পর্ক ছিল। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার জন্যই আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে গঠিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ। সেই অসাম্প্রদায়িকতা মানে কি ধর্মহীনতা? মোটেই না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ধর্মের যোগসূত্র ছিল। বাংলার সহজিয়া, উদার, সমন্বয়বাদী ও অসাম্প্রদায়িক ইসলামি সিলসিলার প্রতি ছিল তাদের বিশ্বাস। সেই কারণেই আওয়ামী লীগের প্রতি এই সিলসিলার মানুষদের অকুণ্ঠ সমর্থন। এই সিলসিলা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন সুরজিৎদাশ গুপ্তের `ভারতবর্ষ ও ইসলাম` বইটি।
আওয়ামী লীগ বাংলার সহজিয়া ইসলামের ধারাকে উপেক্ষা করতে লাগল ২০১৩ পরবর্তীকালে। যে আওয়ামী লীগ জামায়াতে ইসলামীর মতো রাষ্ট্রবিরোধী, উগ্র ও সাম্প্রদায়িক দলকে নাস্তানাবুদ করল, সেই আওয়ামী লীগ আপস শুরু করল মুদ্রার ওপিঠের একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে। এই গোষ্ঠীর সংক্ষিপ্ত নাম `হেফাজতে ইসলাম`। এই গোষ্ঠীর অনুসারীরা চেতনায় ভিনদেশি। তারা মনে করে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের জন্ম হয়েছে বাংলাদেশে। তারা মূলত আরবের, ইরানের, তুরানের, পাকিস্তানের বংশধর। এই কারণে বাংলা ভাষার চেয়ে তাদের কাছে আরবি, পারসি ও উর্দু ভাষা গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাদের পড়ালেখার মাধ্যমও এই তিনটি ভাষা। তারা জাতীয় পতাকাকে স্বীকার করে না। তাই তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তারা জাতির পিতা হিসেবে স্বীকার করে না। কারণ তাদের জাতির পিতা ইব্রাহিম (আ.)। তারা মানতে চায় না জাতি ও সম্প্রদায় যে এক নয়।
সেই উগ্র সাম্প্রদায়িক, বাঙালি ও বাংলাদেশ বিদ্বেষী গোষ্ঠীর `শোকরানা মাহফিলে` যোগ দিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার ঝাণ্ডাবাহী, অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই মঞ্চে বসলেন শীর্ষ একজন সাম্প্রদায়িক ব্যক্তির সঙ্গে। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ তার ঐতিহ্য থেকে এক সিঁড়ি নিচে নেমে দাঁড়াল। অর্থাৎ তার ঐতিহ্যচুত্যি ঘটল।
মার্কিন ও আরব সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর উচ্ছিষ্টভোগী এই হেফাজত অনুসারীদেরকে ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ যে পেঁদানিটা দিয়েছিল, তাতে তারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। সেই ভয়ে আগামী পঞ্চাশ বছর তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস করত না। অথচ আওয়ামী লীগ পেল কিনা উল্টো ভয়! সেই ভয়ে কিংবা আরব ও মার্কিনিদের খুশি করতে আওয়ামী লীগ শুরু করল হেফাজত-তোষণ। হেফাজতকে মাথায় তুলতে লাগল। হাটহাজারী মাদ্রাসাকে জমি দিল, ক্বওমি সনদের স্বীকৃতি দিল।
তা দিক। রাজনীতির প্রয়োজনে দেয়া যেতেই পারে। কিন্তু আজ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, যে উদ্যানে ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, যে উদ্যানে আত্মসমর্পণ করেছিল হানাদার বাহিনী, সেই উদ্যানে হেফাজতের শীর্ষ নেতার সাথে একই মঞ্চে বসলেন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির সর্বশেষ কাণ্ডারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই বসার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক স্বীকৃতি পেল হেফাজত। কোণঠাসা হলো অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষেরা।
দরকার ছিল না। দরকার ছিল না আওয়ামী লীগের মতো একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের এতটা আপসকামিতার। বাংলাদেশ, বাঙালি ও বাংলা ভাষা বিরোধী এই গোষ্ঠীর সঙ্গে আপস না করলে কী হতো? কিচ্ছু করতে পারত না তারা। কারণ তারা নিজেরাই জানে তারা যে আরব-মার্কিন সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। তারা জানে তাদের মেরুদণ্ড কতটা দুর্বল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আজ এসব মেরুদণ্ডহীন এবং দেশ, জাতি ও ভাষা বিরোধীদের মেরুদণ্ডকে ঠেকা দিলেন। তাই বলে কি তারা দলে দলে আওয়ামী লীগে যোগ দেবে? তৃণমূলে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করবে? ভোটটা আওয়ামী লীগকে দেবে? প্রশ্নই আসে না। তাদের দাবি অনুযায়ী আওয়ামী লীগ যদি এই বাংলাদেশে ইসলামি হুকুমতও চালু করে, খলিফার যুগও যদি ফিরিয়ে আনে, তবু আওয়ামী লীগকে তারা ইসলামের দুষমন মনে করবে, তবু তাদের ভোটটি আওয়ামী লীগকে দেবে না।
আজকের তথাকথিত শোকরানা মাহফিলের জন্য শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা পর্যন্ত পিছিয়ে দেয়া হলো। খোদ হেফাজতও এতটা আশা করেনি। আজকের পর থেকে হেফাজত গোষ্ঠী যে আরও উদ্ধত হবে না, আরও বেপরোয়া হবে না, তা কে বলতে পারে? এই আপসকামী আওয়ামী লীগকে দেখে মন খারাপ হলো। সেই মন খারাপের কথামালা টুকে রাখলাম। আপসকামিতার প্রতিবাদ জানিয়ে রাখলাম।
টুকে রাখা কথামালা
কলকাতা, ৪ নভেম্বর ২০১৮