আন্তন চেখভের গল্প ‘কেরানির মৃত্যু’

পুনর্মুদ্রণ

অনুবাদ: অরুণ সোম

প্রকাশিত : জুলাই ১৫, ২০১৯

অপরূপ একরাতে নাম-করা কেরানি ইভান দমিত্রিচ চেরভিয়াকভ স্টলের দ্বিতীয় সারিতে বসে অপেরা গ্লাস দিয়ে ‘লা ক্লশে দ্য কর্নেভিল’ অভিনয় দেখছিলেন। মঞ্চের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তাঁর মনে হচ্ছিল, মরজগতে তাঁর মতো সুখী বুঝি আর কেউ নেই। এমন সময় হঠাৎ...’হঠৎ’ কথাটা বড়ো একঘেয়ে হয়ে পড়েছে। কিন্তু কী করা যায় বলুন, জীবনটা এতই বিস্ময়ে ভরা যে কথাটা ব্যবহার না করে লেখকদের গত্যন্তর নেই।

সুতরাং, হঠাৎ, ওর মুখখানা উঠল কুঁকড়ে, চক্ষু শিবনেত্র, শ্বাস অবরুদ্ধ... এবং অপেরা গ্লাস থেকে মুখ ফিরিয়ে সিটের উপর ঝুঁকে পড়ে—হ্যাঁচ্চো! অর্থাৎ হাঁচলেন। হাঁচার অধিকার অবশ্যই সকলেরই আছে, এবং যেখানে খুশি । কে না হাঁচে—চাষী হাঁচে, বড়ো দারোগা হাঁচে, এমন কি প্রিভি কাউন্সিলররাও মাঝে মাঝে হাঁচে, হাঁচে সবাই। কাজেই চেরভিয়াকভ একটুও অপ্রতিভ না হয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে নাক মুছলেন, এবং সভ্যভব্য মানুষের মতো আশেপাশে তাকিয়ে দেখলেন কারুর কোনো অসুবিধা হল কিনা। আর তাকাতে গিয়েই বিব্রত হতে হল তাঁকে। কেন না, চোখে পড়ল ঠিক তাঁর সামনে, প্রথম সারিতে একটি খর্বকায় বৃদ্ধ দস্তানা দিয়ে টেকো ব্রহ্মতালুটুকু এবং ঘাড়খানা সযন্তে মুছে বিড় বিড় করে কী বলছেন। বৃদ্ধটিকে চেরভিয়াকভ চিনতে পারলেন। তিনি ছিলেন যানবাহন মন্ত্রিদপ্তরের বেসামরিক জেনারেল ব্রিঝালভ।

চেরভিয়াকভ ভাবলেন, সর্বনাশ, ওর মাথার ওপরেই হাঁচে ফেলেছি তাহলে। উনি অবশ্য আমার বড়ো সায়েব নন, তবু কাজটা খারাপ হয়ে গেল। ক্ষমা চেয়ে নেওয়া দরকার।

একটু কেসে চেরভিয়াকভ সামনে ঝুঁকে জেনারেলের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘মাফ করবেন স্যার, হেঁচে ফেলেছি, ... অনিচ্ছায়।‘
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে...’
‘ভগবানে দোহাই, আপনি আমায় মাফ করুন। আমি... মানে ব্যাপারটা ঠিক ইচ্ছে করে ঘটেনি।‘
‘কী জ্বালা, থামুন দিকি! শুনতে দিন!’

কিঞ্চিৎ হতভম্ব হয়ে চেরভিয়াকভ বোকার মতো হাসলেন। তারপর মঞ্চের দিকে চোখ ফিরিয়ে অভিনেতাদের দিকে তাকাতে লাগলেন। তাকালেন বটে, কিন্তু কিছুতেই আর মরজগতের সবচেয়ে সুখী মানুষটি বলে নিজেকে ভাবতে পারলেন না। অনুশোচনায় মরে যাচ্ছিলেন তিনি। ইন্টারভেলের সময় হতে চলে এলেন ব্রিঝালভের কাছে। একটু ইতস্তত করে সঙ্কোচ কাটিয়ে গুঁই গুঁই করে শুরু করলেন, ‘ আপনার গায়ের উপর তখন হেঁচে ফেলেছিলাম, স্যার... আমাকে মাফ করুন...মানে ব্যাপারটা আমি ঠিক ইচ্ছে করে করিনি...’

জেনারেল বললেন, ‘ও, তাই নাকি... আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি কি এমনি ঘ্যান ঘ্যান করতেই থাকবেন?’ নিচের ঠোঁটটা অধৈর্যে বেঁকে উঠল তাঁর।
চেরভিয়াকভ কিন্তু জেনারেলের দিকে অবিশ্বাস ভরে তাকালেন। তাঁর মনে হল, ‘উনি তো বলে দিলেন ব্যাপারটা ভুলে গিয়েছেন, কিন্তু কই, ওঁর চোখমুখ দেখে তো ভালো ঠেকছে না। আসলে আমার সঙ্গে কথা কইতেই উনি নারাজ। উঁহু ব্যাপারটা ওঁকে বুঝিয়ে বলতেই হবে যে ওটা আমি ইচ্ছে করে করিনি... এ হল গিয়ে একটা প্রাকৃতিক নিয়ম। নইলে উনি হয়তো মনে করবেন আমি বুঝিবা ওঁর গায়ের উপর থুতু ফেলতেই চাইছিলাম। এখন সে কথা যদি বা নাও ভাবেন পরে যে ভাববেন না তার ঠিক কি...!’

বাড়ি ফিরে চেরভিয়াকভ তাঁর অশিষ্ট আচরণের কথা স্ত্রীর কাছে খুলে বললেন। মনে হল স্ত্রী যেন বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না। প্রথমে অবশ্য তাঁর স্ত্রীও একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলে। কিন্তু যেই শুনলেন ব্রিঝালভ ওঁদের আপিসের কর্তা নন, অমনি নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন। তবু পরামর্শ দিলেন, ‘তা যাই হোক, ওঁর কাছে তোমার ক্ষমা চাওয়া উচিত। নইলে উনি হয়ত ভাববেন, তুমি ভদ্রতাও জানো না।‘

‘ঠিক বলেছো। ক্ষমা চাইতেই গিয়েছিলাম। কিন্তু উনি ভারি অদ্ভুত ব্যবহার করলেন। যা বললেন তার মানেই হয় না। তাছাড়া তখন আলাপ করার মতো সময়ও ছিল না।‘
পরদিন চেরভিয়াকভ আপিস যাবার নতুন ফ্রককোটটি গায়ে চাপিয়ে, চুলটুল ছেঁটে ব্রিঝালভের কাছে গেলেন তাঁর আচরণের কৈফিয়াত দাখিল করতে। জেনারেলের বসবার ঘরখানা দরখাস্তকারীদের ভিড়ে ভরে উঠেছে। জেনারেল স্বয়ং হাজির থেকে দরখাস্ত গ্রহণ করছেন। জনকয়েকের সঙ্গে সাক্ষাৎকার শেষ করে জেনারেল চেরভিয়াকভের দিকে চোখ তুলে চাইলেন।

কেরানিটি শুরু করলেন, ‘ বলেছিলুম কি, স্যারের বোধ হয় মনে আছে, কাল রাত্রে, সেই যে আর্কেডিয়া থিয়েটারে আমি, মানে হেঁচে ফেলেছিলাম, মানে হাঁচি এসে গিয়েছিল... দয়া করে ক্ষমা!...’

‘কী জ্বালা! আচ্ছা আহাম্মকের পাল্লায় পড়েছি তো!। ‘ বলে জেনারেল পরবর্তী লোকটিকে উদ্দেশ্য করে জিগ্যেস করলেন, ‘আপনার কী দরকার বলুন?’
চেরভিয়াকভের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ভাবলেন আমার কথা উনি শুনতেই চান না! তার মানে চটে আছেন। কিন্তু ওঁকে এরকম চটিয়ে রাখা তো ঠিক হবে না...ওঁকে বুঝিয়ে বলা দরকার...’

সর্বশেষ দরখাস্তকারীর সঙ্গে কথা শেষ করে জেনারেল যখন তাঁর খাস কামরার দিকে পা বাড়িয়েছেন, অমনি চেরভিয়াকভ গিয়ে তার পিছু ধরলেন এবং বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, ‘ মাপ করবেন, আমার এমন একটা আন্তরিক অনুশোচনা হচ্ছে যে আপনাকে আবার বিরক্ত না করে পারছি না...’

জেনারেল এমনভাবে চেরভিয়াকভের দিকে তাকালেন যেন বুঝি তিনি কেঁদে ফেলবেন। হাত নেড়ে চেরভিয়াকভকে ভাগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমাকে নিয়ে তামাসা পেয়েছেন, না?’ কেরানির মুখের সামনেই দরজা বন্ধ করে দিলেন।

‘তামাসা!’ চেরভিয়াকভ ভাবলেন, ‘এর মধ্যে তামাসার কী আছে। জেনারেল হয়েও কিন্তু কথাটা বুঝতে পারছেন না। বেশ, মাপ চাইতে গিয়ে ভদ্রলোককে আমিও আর বিরক্ত করতে আসছি না। চুলোয় যাক! বরং একটা চিঠি লিখে জানিয়ে দেওয়া যাবে, ব্যাস। এই শেষ, আর কখনো আসছি না ওঁর কাছে।

বাড়ি যেতে যেতে চেরভিয়াকভের চিন্তা এই ধরনের খাতে বইছিল। চিঠিখানা কিন্তু তাঁর লেখা হয়ে উঠল না। ভেবে ভেবে কিছুতেই ঠাহর করতে পারলেন না, কথাগুলো কী করে সাজাবেন। সুতরাং ব্যাপারটা ফয়সালা করে নেবার জন্যে পরের দিন আবার তাঁকে যেতে হল জেনারেলের কাছে।

জেনারেল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাতেই চেরভিয়াকভ শুরু করলেন, ‘গতকাল আপনাকে একটু বিরক্ত করতে হয়েছিল, কিন্তু তার মানে আপনি যা বলতে চাইছিলেন তা নয়। রসিকতা করার কোন মতলবই আমার ছিল না। সেদিন হেঁচে ফেলে আপনার যে অসুবিধা ঘটিয়েছিলাম, তার জন্যে মাপ চাইতেই এসেছিলাম...আপনাকে নিয়ে রসিকতা করার কথা আমার মনেই হয়নি। তাই কখনো হয়! লোককে নিয়ে রসিকতা করার ইচ্ছা যদি একবার আমাদের পেয়ে বসে তাহলে কোথায় থাকবে মানসম্মান, কোথায় থাকবে আমাদের ওপরওয়ালাদের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা?...’

রাগে বিবর্ণ হয়ে কাঁপতে কাঁপতে জেনারেল হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, ‘ নিকালো! আভি নিকালো!’

আতঙ্কে বিমূঢ় হয়ে চেরভিয়াকভ বললেন। ‘আজ্ঞে?’
পা ঠুকে জেনারেল ফের চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘আভি নিকালো!’

চেরভিয়াকভের মনে হল বুঝি ওঁর শরীরের মধ্যে কী একটা যন্ত্র যেন বিকল হয়ে গেল। কান ভোঁ ভোঁ করছে, চোখে দেখা যাচ্ছে না কিছুই। দরজা দিয়ে কোনো মতে পেছিয়ে এসে হোঁচট খেতে খেতে চেরভিয়াকভ হাঁটতে শুরু করলেন। আচ্ছন্নের মতো বাড়ি পৌঁছে আপিসের ফ্রককোট সমেতই সোফার উপর শুয়ে পড়ে মরে গেলেন।

১৮৮৩