আত্মহত্যা প্রবণতা ও এর নেপথ্যে
শাহেরীন আরাফাতপ্রকাশিত : মে ১২, ২০১৯
কয়েক দিনে হাজারো কাজ ও দায়িত্বের ভিড়েও একটা বিষয় নিজের ভেতর থেকে বের করতে পারছি না, আত্মহত্যার মিছিল আদতে আমাদের কী বার্তা দিচ্ছে? এর দায় আসলে কার উপর? ওই আত্মহননকারীরাই কি হত্যাকারী, না কি এর দায় অন্য কারো? সমাজ-রাষ্ট্রের কি এতে কোনো ভূমিকা নেই?
হিমু, যাকে অনেকেই চেনেন রানা প্লাজা ধসের পর ধ্বংসস্তূপে আটকা পড়া শ্রমিকদের উদ্ধারে অগ্রণী ভূমিকা রাখাদের একজন হিসেবে। গত মাসে হিমু আত্মহত্যা করেছেন, অথবা বলা যায়, এই রাষ্ট্র-সমাজ তাকে বাঁচতে দেয়নি। রানা প্লাজায় শ্রমিক গণহত্যার পর থেকেই হিমু ট্রমাটাইজড ছিলেন। একজন সাধারণ মানুষ যখন অন্য একজনের হাত-পা কেটে ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করছেন, যখন বহু মানুষ তার সামনে ধ্বংসস্তূপে আটকা পড়ে মারা যাচ্ছে— এমন দৃশ্য কাছ থেকে দেখার পর কয়জন সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারবে, তা অবশ্যই গবেষণার বিষয়। ওই বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের কেউ কেউ আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। তারা যেমন রাষ্ট্রের কাছ থেকে মানবিক কোনো সহযোগিতা পায়নি, তেমনি যে কথিত ক্ষতিপূরণের কথা তাদের বলা হয়েছিল, সেটুকুও তাদের দেয়া হয়নি। লোক-দেখানো সাহায্যে আরও উন্নতি ঘটেছে মালিকশ্রেণির। সংসদ সদস্যদের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি গার্মেন্টস মালিক। তাদের যতরকম ছাড় দেয়া সম্ভব, তা এই রাষ্ট্র বরাদ্দ করেছে ও করছে। চারদিকে ছড়িয়ে থাকা অমানবিকতা হিমুকে ওই সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচনা যুগিয়েছে।
মাত্র কয়েক দিন আগে তমা খান চলে গেলেন। তার সম্পর্কে যেটুকু জেনেছি, তিনি বেশ হাসিখুশি মানুষ ছিলেন। সম্পর্ক বিষয়ক জটিলতা নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব রেখেছে। তবে শুধু মাত্রা ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতির কারণে কোনো মানবিক সমাজে কোনো সুস্থ, স্বাভাবিক, প্রাণবন্ত মানুষ নিজেকে মেরে ফেলতে উদ্ধত হতে পারে না, আর যদি তেমনটা হয়— তবে বুঝতে হবে ওই সমাজটা মানুষের বসবাসের উপযোগী নয়। আর সে দায়টাও সমাজ-রাষ্ট্র এড়াতে পারে না। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী শিক্ষাব্যবস্থা ও ক্ষমতাসীনদের দায়ী করে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। কিন্তু এ রাষ্ট্র বা তার ধারক কথিত প্রগতিশীল নামধারীরা এর কারণ অনুসন্ধানে বিন্দুমাত্র আগ্রহ বোধ করেনি। তারা এ সমস্যাটিকে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকেই দেখেছে, বা দেখানোর কথা বলে জনগণকে ধোঁকা দিয়েছে।
এমন আরও বহু মানুষ প্রতিদিন নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন এ সমাজ থেকে। প্রতিনিয়ত মানুষের মধ্যে বাড়ছে ‘সুইসাইডাল ট্যান্ডেন্সি’। একটা অমানবিক, বসবাস অযোগ্য সমাজে কোনো মানুষই সুখী তো দূরের কথা— সুস্থির বা সুস্থও নয়। আর যারা এ সমাজকে ‘মানবিক’ বা ‘উন্নত’ বলে হাজির করছে, তারা নিখাদ শোষক শাসকশ্রেণির দালাল, ভণ্ড, গণবিরোধী। তারাই সীমান্তে ভারতীয় খুনী বাহিনী সাধারণ নাগরিকদের হত্যা করলে সাফাই শোনায়। ফ্যাসিবাদের যুক্তি, আপনার বাড়ির সুপারি গাছ অন্য কেউ তুলে নিয়ে গেলে, আপনি কি ছেড়ে দেবেন। অর্থাৎ, তারা ‘বন্ধুত্বের নিদর্শন’ হিসেবে চোরাকারবারিদের হত্যার অঘোষিত লাইসেন্স দিচ্ছে। আবার বিচারহীনতার কারণে চুরির মতো সাধারণ বিষয়ে সংঘবদ্ধ পিটুনিতে হত্যা করার সংস্কৃতিটাও এ সমাজে বেশ সফলতার সঙ্গে প্রয়োগ করেছে ফ্যাসিবাদীরা। উল্লেখ্য, ফ্যাসিবাদীদের চোখে দু-চার শত, বা হাজার টাকা চুরি করা ‘ভীষণ বড় অপরাধ’। আবার হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করা অতিসামান্য, রাবিশ!
ফ্যাসিবাদের চোখে কখনোই মানুষ প্রধান নয়, বরং তার ব্যবস্থায় মানুষ ব্যবহৃত যন্ত্র মাত্র! যেখানে মানুষ একইসঙ্গে পণ্যের উৎপাদনকারী, ক্রেতা, আবার সে নিজেও পণ্য। ফ্যাসিবাদের চোখে ‘উন্নয়ন’ মানে দালান-কোঠার উন্নয়ন, সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির উন্নয়ন— সেখানে মানুষ নেই, মানবিকতা নেই। ‘উন্নয়নের গণতন্ত্র’ নামে আমাদের যে সিরাপ গেলানো হয়েছে ও হচ্ছে, সেখানে ধর্ষণের উন্নয়ন হয়েছে, প্রতিদিন এখন গড়ে ৪০ জন ধর্ষণের শিকার হয়। আজ যে শিশুটি জন্ম নেবে, তার মাথায় ৬৭ হাজার ৫০০ টাকা ঋণের দায় চাপবে। এ ঋণের বোঝা নিত্য নতুন গোপন ও প্রকাশ্য গণবিরোধী চুক্তির মাধ্যমে বেড়েই চলেছে।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশে রোজার মাস মানেই যেন এক ভীতিকর অবস্থা! এ সময়ে নিত্য প্রয়োজনীয় প্রতিটা পণ্যের দাম দ্বিগুণ, তিন গুণ বাড়িয়ে সাধারণ জনগণকে অনাহারে-অর্ধাহারে রাখা হয়। ফ্যাসিবাদীরা ধর্মকে তার অন্যতম ঢাল হিসেবে ব্যবহার করলেও এ ক্ষেত্রে লোক দেখানো কিছু অভিযানই সার! এমনকি ধর্মবাদী নেতারা ধর্মের নামে ভীতি প্রদর্শন করে আসলেও এসব গণবিরোধিতার প্রশ্নে নীরব। তারা নাকি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি পছন্দ করে না! তবে ব্যক্তিগত স্বার্থে, একসময় যাদের বিরোধিতা করেছে, এখন তাদের পা চেটে ‘আম্মাজান’ বানাচ্ছে!
অপরদিকে, এমন হাজারো গণবিরোধী অবস্থানের পরও সাধারণ মানুষ যেন মুখে কূলুপ এঁটে রাখে, সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। সমাজের প্রতিটা স্তরে ভীতি ও বিচারহীনতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখন যেকোনো ঘটনায় আইন-আদালতের আগে ক্ষমতাসীন স্থানীয় নেতার বাড়ির খোঁজ করা হয়। এমনকি হত্যা বা ধর্ষণের মতো ঘটনাও ক্ষমতাসীনদের নামে ধামাচাপা পড়ে যায়!
‘মধ্যম আয়ের দেশে’ চাকরিহারা এক পিতা তার সন্তানের জন্য দুধের কৌটো চুরি করেন। এতে বোঝা যায়, ১০ টাকা কেজি চাল তো দূরের কথা, কর্মসংস্থানের নামে যেসব গাল-গপ্পো আমাদের শোনানো হয়েছিলো, তার সবই ছিলো ধোঁকা। এই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যখন কেউ আওয়াজ তোলেন, তখন তাকে হাজারো ট্যাগ দিয়ে, মামলা দিয়ে আটকে রাখা হয়, অথবা তাকে গুম করা হয়। গত মাসে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সংগঠন ইউপিডিএফ-এর সংগঠক মাইকেল চাকমাকে অপহরণ করা হয়। এখনো তার কোনো খোঁজ মেলেনি। মাইকেল চাকমার নিখোঁজ হওয়া নিয়ে বেশি কথা বলার মতো অবস্থাও সাধারণ জনগণের নেই। তারা একের পর এক ইস্যুতে জর্জরিত। ভোটের রাতে সুবর্ণচরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার নারী যে আত্মহত্যা করেছেন, সে খবরটিও অনেকে জানেন না হয়তো। নুসরাতকে নিয়ে এতো কান্নাকাটি, সেটাও এখন ম্রিয়মান। কল্পনা চাকমা গুম হলেন প্রায় দুই যুগ হলো, রাজনৈতিক মতভিন্নতার কারণে এমনি করে প্রতিনিয়ত মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। নিত্যনতুন তত্ত্ব দেয়া হচ্ছে, নিখোঁজ মানুষগুলো নাকি প্রেমে ও ব্যবসায় ধোঁকা খেয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছে!
চলমান এই ব্যবস্থায় কোনো মানুষ সুস্থ থাকতে পারেন না, অথবা এই ব্যবস্থা কোনো মানুষকে সুস্থ থাকতে দেবে না। আর এখানেই আসে বিদ্রোহের প্রশ্ন। যখন কোনো পথ কেউ খুঁজে না পান, তখন আত্মহত্যাকেই তিনি বেছে নেন বিদ্রোহের পথ হিসেবে। অথচ এই পথ কার্যত বিদ্রোহের দিকে নয়, ফ্যাসিবাদের পথকে দীর্ঘায়িত করে। কারণ এসব আত্মহত্যা এ ব্যবস্থার কলুষতাকে সামনে এনে দাঁড় করায়, কিন্তু এ ব্যবস্থা থেকে বের হওয়ার পথ দেখায় না, এমনকি আত্মহত্যার জন্য উল্টো ওই ব্যক্তিকেই দোষী করা হয়।
তাই এই উপলব্ধি জরুরি- সমষ্টির মুক্তি ছাড়া ব্যক্তি কখনোই মুক্ত হতে পারে না। আর এজন্য এই ব্যবস্থাকেই দায়ী করতে হবে। শেকড়সমেত এই ব্যবস্থাকে উপড়ে ফেলে ব্যাপক নিপীড়ত জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনকেই লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। জনগণের সামষ্টিক শক্তির বলেই ফ্যাসিবাদের পতন সম্ভব।
বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত
যে মানুষগুলো নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে ও নিচ্ছে, অথবা যাদের বিচারিক বা নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে— রাষ্ট্র ও সমাজ তাদের উপর সব দোষ চাপিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারে, আপনি, আমি তা করতে পারি না— তাদের আমি চিনি বা না চিনি— তারা আমার আপনজন...
Who cares if one more light goes out?
In a sky of a million stars
It flickers, flickers
Who cares when someone`s time runs out?
If a moment is all we are
We`re quicker, quicker
Who cares if one more light goes out?
Well I do...”
চেস্টার বেনিংটন, লিংকিন পার্ক