আত্মদীপের গল্প ‘যবনিকা’

প্রকাশিত : জুলাই ১৯, ২০২২

যুদ্ধ শেষ। যত দূর চোখ যায় কেবল চিতার আগুনের শিখা নজরে আসে। একটা তীব্র চাপা মাংস পোড়ার গন্ধ শ্বাস অবরুদ্ধ করে দ্যায়। চোখের দৃষ্টিকে বেশিক্ষণ স্থির রাখা যায় না। সব যেন কেমন ঝাপসা হয়ে আসে। কী হারায়নি এই যুদ্ধে? উভয় পক্ষ আজ নিঃস্ব-রিক্ত। বিধবা রমণী আর সন্তানহারা মাতৃত্বের ক্রন্দন কর্ণকুহরে যেন বিষ সঞ্চারিত করে দ্যায়।

আজ সকাল থেকেই আকাশ ঘন কালো মেঘে আচ্ছন্ন ছিল। বজ্রের রোষ এত তীব্র আঘাত হেনেছে যে, এই হত্যাক্ষেত্রের একেবারে শেষপ্রান্তে যে কচি পাতায় ভরা কদম্ব গাছটি ছিল, শেষ একটু আশার মতো প্রজ্জ্বলিত, সেটিও আজ পরমা পৃথিবীর মাতৃত্বের বন্ধন ছিন্ন করেছে। বৃষ্টি এসেছে অনেক আগে। চিতাগ্নির লেলিহান শিখা তবু যেন নিভতে চায় না। পোড়া কাঠে জল পড়েছে। ধোঁয়া উদগীরণে চারপাশ ভালো দ্যাখা যায় না। মাধব এই বন্ধ্যা প্রান্তরের একেবারে প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন নিশ্চুপ। তার ক্লান্ত বার্ধক্যগ্রস্ত শরীর বৃষ্টির তীরে বিদ্ধ হচ্ছে।

মহারাজ যুধিষ্ঠির আজ বড় বিচলিত। ভবিষ্যৎদর্শী সহদেব আশঙ্কিত। আর তো যুদ্ধ নেই। তবে এ কীসের অশুভ সংকেত! পাণ্ডব শিবির আজ শ্মশানপুরি। আর কীবা আঘাত আসতে পারে! পার্থ বারেবারে সখার কাছে আসছিলেন। চোখে-মুখে জিজ্ঞাসা। আশঙ্কা। আজও যেন শিশু সে! মাধব তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। আজ এই মহাশ্মশানের চিতাগ্নির সামনে দাঁড়িয়ে তিনি ভাবছেন, ধর্মরাষ্ট্রের কথা। চিতা থেকে নির্গত ধোঁয়া কী আজ তার অন্তরের দৃষ্টিও অবরুদ্ধ করে দিচ্ছে? ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কী আদৌ ন্যায় রেখে গেলেন তিনি! কূটনৈতিক তিনি। তবু আজ এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে কিছু যেন স্থির করে উঠতে পারেন না।

সখি কৃষ্ণার মুখ তার বারবার মনে পড়ে যায়। এই মহাশ্মশানের সম্রাজ্ঞি সে আজ। তবু তার দৃষ্টিতে যেন আস্বাদ নেই। কী জীবন! কী বা মৃত্যু! সব যেন এই ধূম-কুহকের মতো অস্পষ্ট ঠেকে। ভগিনী ভদ্রার কথা তিনি স্মরণে আনলেই তার কেবল হাজার হাজার সন্তানহারা মাতার অন্তর বিদারক হাহাকার স্মরণ হয়ে যায়। কৌরব পক্ষ আজ নির্জীব। সব যেন কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছে। ক্রন্দনের শব্দে এক অদ্ভুত নিশ্চুপতা মাধবের অন্তর থেকে অবিরত রক্তপাত ঘটাতে থাকে। হায় রে ধর্মরাষ্ট্র কই? এ যে মহাশ্মশান!

তবু আজ এই ঘনবর্ষার দিনে, এই অসহায় হত্যালীলার মাঝে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ হয়ে আসা প্রাজ্ঞ পুরুষ মাধবের মনে এক সূক্ষ্ম অভিমান কেন দোলা দিয়ে ওঠে? তবে কী কারও স্মরণে নেই? কৃষ্ণা, এমন কী তারও না? ছি... ছি! এসব কী ভাবছেন তিনি। তিনি কৃষ্ণ, এই ভারত যুদ্ধের প্রাণপুরুষ। এহেন ক্ষুদ্র আবেগ তাকে মানায় না। সখা পার্থর তিনি ঈশ্বরপ্রতিম, আর আজ স্বয়ং তিনিই কীনা যাতনা পাচ্ছেন এই সামান্য বিষয়ে। তবু পার্থ, প্রাণসখা তুমি, তুমিও কী ভুলে গেলে! হাজার হাজার অসহায় রমণীর ক্রন্দন কেমন যেন দূর... দূরতর হয়ে যাচ্ছে। আজ এই অন্ধকারগ্রস্ত মৃত্যুর মাঝে, হে মধুসূদন, তোমার জন্মদিন। স্মরণশক্তি শিথিল হয়ে আসে। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিতে থাকেন মাধব বারবার।

দৃষ্টি স্থির থাকছে না কোনোমতে। দূরে অনেক দূরে অমন আলোকবর্ণা কোনো এক জ্যোতির্ময়ী মূর্তি তাকে বারবার করে আকর্ষণ করতে থাকে। এ কী! এই আলোকবর্ণা যে তারই দিকে আসছেন। তবে কী পৃথা? মাতৃত্বের সামান্য স্পর্শের জন্য তৃষিত মাধব চেয়ে থাকেন। ধোঁয়ার কারণে স্পষ্ট দ্যাখা যায় না। পৃথা, ওগো তুমিও যে আমার মাতৃসম। তোমার, তোমারই নিশ্চিত স্মরণে আছে! ও কী তোমার হাতে ও কিসের ভাণ্ড? পায়েসান্ন বুঝি? আহা, আমি, আমি মহান কৃষ্ণ আজ এটুকু আশ্রয়ের জন্য বড় শ্রান্ত। এসো মা, এসো। কিন্তু ও কী, এ যে পৃথা নয়। কৌরব জননী গান্ধারী। হাতে তার পায়েসান্নের ভাণ্ড নয়। ও যে তার প্রিয়তম পুত্র দুর্যোধনের অস্থি! হায়, ধিক! ধিক তোমায় কৃষ্ণ। বিচলিত হওয়া যে তোমায় মানায় না। আসতে দাও তাকে। পরিণাম গ্রহণ করো। তবে না ধর্মরাষ্ট্র স্থাপন হবে।

শান্ত তবু থাকতে চায় না মন। অন্ধকারে যেন বিলুপ্ত হয়ে যেতে বসল সব। তবু হে মন, এহেন ভিরুতা তোমায় মানায় না। আজ যদি তুমি বিচলিত হও, তবে পার্থ... তবে সখি কৃষ্ণা, তাদের এ চরম আঘাত গ্রহণ করার শক্তি দেবে কে? তুমি শান্ত হও। এই তো মাতা গান্ধারী, এসো, বক্ষে গ্রহণ করে অন্তিম আঘাতটুকু দাও, দাও... কৌরব জননীর এ কী রূপ! এ যে দগ্ধ করে দেবে তুমি মা গো! তোমার কিছু হারানোর নেই যে। বলো, এবার ব্রহ্মাস্ত্র বর্ষিত হোক। তুমি তো সব জানতে মাধব। তুমি চাইলে সব থেমে যেতে পারত। তবে কেন, কেন নিশ্চুপ করে দিলে আমার মাতৃক্রোড়! তুমি না নন্দরাজার ঘরে, শত মায়ের দুগ্ধে পালিত? এই কী প্রতিদান মাতৃদুগ্ধের? আজ উন্মাদ আমি হে কৃষ্ণ। সন্তানহারা এই মা তোমাকে, হ্যাঁ তোমাকে, যে তুমি শত মায়ের চোখের কাজল, সেই তোমাকে অভিসম্পাত দিল, তুমি সবংশে নিঃশেষ হয়ে যাবে। স্বাহা!

ও কী মাতা, ওই অস্থি-ছাই তুমি এই মাধব দেহে অর্পণ করলে! ও কী... ও কী আঘাত হানলে হে বজ্র! দিগন্তে  আগুন লেগে গেছে যে! বনে বনে বুঝি দাবানল লাগল... বৃষ্টি গাঢ়তর হয়ে আসে। তবে এ কেমন আলো আজ আমি দেখতে পাই হে মন? এই কী মুক্তি! এই কী মৃত্যু! এই কী জন্ম! অন্ধকার থেকে অন্ধকারের পথে যাত্রা? ওগো মা, তোমার এ বাক্য আমি মাথা পেতে নিলাম। তবে তাই হোক। আজ এই জন্মের স্মৃতি বিজড়িত দিনে তুমি আমায় পুর্নজন্ম দিলে মা গো। মুক্তি, মুক্তির দহনে আজ দগ্ধ আমি। আজ এ অদ্ভুত আঁধারে এত আলো তোমার চরণে দিলাম হে ধরিত্রী, মা গো... এ আঁধারের পথে, আমায় নবজন্ম দাও...!