আত্মদীপের গল্প ‘করাতের আর্তনাদ’
প্রকাশিত : আগস্ট ৩১, ২০২১
কোন জন্মে মানুষ ছিল, তার মনে পড়ে না। আয়নায় মুখ দ্যাখা ঘুচেছে অনেক কাল। সেই যে বছর আশ্বিনের ঝড় এলো, কুট রোগে ছেয়ে গেল শরীর। মাথাটা কেমন যেন করতো প্রথমদিকে। বসে বসে মাথার চুল ছিঁড়তো অলকা। বাচাল মেয়ে মানুষের মতো এ ঘর ও ঘর করতো। কাপড়-চোপরের ঠিক থাকে না। ওর ছেলে দুলাল তখন সবে তার ঘরে দুলালি এনেছে, নাম মালতী, ঘোষ বাড়ি থেকে বাসন মেজে ফেরার পথে অলকা কতদিন ওকে লাইনে দাঁড়াতে দেখেছে। কিন্তু বিয়ের পর সে হারামজাদি সতি সাজলো, দুলালের বাপ মরতে ক্যামন করে চোদ্দ বাড়ি কাজ করে ছেলেকে সে মানুষ করেছে, এ কথা প্রথম দিকে অলকা রোজ বৌমাকে শোনাতো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতো, তা সে দলু যে এমন করবে, ক্যা জানত... সবই অদ্যেষ্ট!
মালতী রা করতো না। প্রথমদিকে একটু ভক্তি-চ্ছেদ্দা করতো। দলু তার ছেলে এমন, সে এমনি নিরীহ তো কী, হকারি করে যখন দিশি ঢেলে সে রাতে বাড়ি ফিরত, তখন সে-ই রাজা, বেগরবাই দেখলে আর রক্ষে থাকত না। তখন অবশ্য অলকার মাথাটা এতটা খারাপ ছিল না। তারপর কী যে হলো! ঠিকে ঝির কাজগুলো এক এক করে গেল, টাকার গরম আর রইল না। ছেলের নির্ভর ঘরবসা অলকা ততদিনে বস্তির আলিপাগলি, তার সারা গায়ে শ্বেতি উঠল, সারা দিন বসে বসে মাথার চুল ছেঁড়ে... গায়ের কাপড় গায়ে রাখতে চায় না... মালতী তখন ভরা পোয়াতি, একদিন কী মরতে গেলাস ছুঁড়ে কেন যে ওর কপাল ফাটালো, তখন সে মাগির কী ঢং! সেদিন বোধহয় দলু নেশাটা একটু বেশিই করেছিল। সেই রাতে আলিপাগলির চিৎকার গোটা বস্তি শুনে ছিল... ও দলুর বাপ, মারে ফেল্লি গো... ওগো আর বাঁচবা না!..এ মারি ফেল্লি...
কিন্তু ওই শেষ। তারপর থেকে আর আলিপাগলির চিৎকার কেউ শোনেনি... সে আর কথা বলে না, বসে বসে মাথার চুল ছিঁড়ে ছিঁড়ে মাথার সামনেটা টাক পড়ে গেছে... মালতীর হয়েছে পাগলি নিয়ে বড় আপদ! ভাতের থালার খোঁজ থাকে না, তবু কী গোদা লাশ!
দুলালের চার বছরের ছেলেটা পর্যন্ত কাছে ঘেঁষে না... যদি কোনো বা মনের ভুলে কাছে চলে যায়, মালতী খেঁকিয়ে ওঠে, এ ছেলে নচ্ছারের ঝাড়! ও ডাইনির কাছে সেই যাবে, কখন কামড়ে দ্যায় কী নজর দ্যায়...!
ছেলেটি পিছিয়ে যায়...
অলকার কোনো খেয়ালই থাকে না। কত কী মনে পড়ে, নিজেই ঠাহর করতে পারে না! দুয়ারের এককোণে নিমগাছের তলাটায় বসে থাকে। ঘন ঘন মাথা নাড়ে।
এদিকে অমন মোটা মানুষ বসে থাকার ঝামেলা অনেক। মিস্ত্রীদের আসতে যেতে অসুবিধা। দুলাল দু কুঠুরি পাকা ঘর করছে কীনা! আজ সকাল থেকে গাছ কাটার লোক এসে দাঁড়িয়ে আছে। পাগলির কী মনে হয়েছে কী জানি, সে কিছুতেই গাছটা কাটতে দেবে না!
দুলালের বাপ যে কত জন্ম হলো মরেছে, তার ঠিক নেই। তবু তার চিকন মুখটা পাগলির আজকাল খুব মনে পড়ে। সে লোক অনেক সোহাগ করে এ গাছ পুঁতেছিল। লোকে ওকে পাগল বলে। অথচ ওর কেমন মনে আছে... যেদিন বুকে বেদনা উঠল, দুলালের বাপ এই গাছের কাছটাতেই বসে শেষ জল চেয়েছিল... এ গাছ তখন কতটুকু! দুলাল গাছের গায়ে ছেলে বয়েসে আঁক কাটতো, রে মা দ্যাখ ক্যামন ইনজেরি নিকেছি।
অলকা ঘাম মুছতে মুছতে ভাবতো, দুলাল বড় হবে, আর দুঃখ থাকবে না।
কিন্তু সে যাই হোক, তা বলে এ কী আবদার! ছেলে তার ঘরে নেই, বৌমা একা এ পাগলামি কত আর সামলাবে! কুকুর বাঁধা চেনটা এনে হাত দুটো কোনোক্রমে বেঁধে ফ্যালে। সেও লাইনে দাঁড়ানো মাগি, জোর করতে খুব জানে! পাগলি ততক্ষণে অস্থির হয়ে উঠেছে। দু চারটে চড় কষিয়ে মিস্ত্রীদের বলে, কোনের ঘরে রশি দিয়ে বেঁধে রেখে এসো। দরজাটা আগল দিয়ে দিও দিকি একটু দাদা।
আলিপাগলি যেন মরিয়া হয়ে ওঠে। সে যাবে না। চিৎকার করতে থাকে। কিন্তু একা বুড়ো হাড়ে কত আর লাঠির ঘা খাবে! গাছটার গায়ে একটা করে কোপের শব্দ যেন উন্মাদ অলকার শিরা-উপশিরা ছিঁড়ে ফেলতে থাকে, ও দুলালের বাপ, তুমায় মারি ফেললো গো... ও দুলালের বাপ... ওরে আমায় ছাড়ি দে রে...
অনেক দিন পর আলিপাগলির চিৎকার, তার মানে ঘটনায় রঙ্গ আছে, ঘরের কাজ ঘরে পরে থাকে... দুলালের ভিটের সামনে ভিড় গাঢ় গাঢ়তর হয়। কেমন সব মজা দ্যাখা চোখ তাদের। পাগলির চিৎকারে শ্বাস যেন ভরে ভরে আছে। সব শব্দ ছাপিয়ে কেবল করাতের নির্মম আর্তনাদ বস্তির টুকরো আকাশে ধাক্কা খেতে থাকে।