আজহার ফরহাদের নির্বাণগল্প ‘পাথর ও শক্তি’
প্রকাশিত : মার্চ ২৭, ২০২১
চন্দনবীজের বাকসো থেকে বেরিয়ে এলো একটা পুরনো ভিক্টোরিয়ান পয়সা। লোহাতে যেমন জং ধরে তেমনি তামার পয়সাতেও ফিরোজা-সাদা একধরনের দাগ ধরে। দেখে মনে হতে পারে, কেউ বুঝি রং মেখে গেছে। এরকম বেশ কয়েকটি পয়সা নাড়িয়ে দেখতে গিয়ে উসমান বখস উত্তেজিত হয়ে বললেন, পেয়ে গেছি সাধুজি! এই জিনিসটাই আপনাকে দেখাতে চাইছিলাম।
একটা বহু পুরনো ইংরেজ আমলের প্রায় ছিঁড়ে যাওয়া দলিলের পাতায় মোড়া একটি পাথর হাতে নিয়ে সাধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, কিছু বলছেন না। মাথার ওপর পুরনো একটা ফ্যান হালকাভাবে বাতাস দিচ্ছে, সেদিকে তাকালেন। বললেন, এই ফ্যানটির চাইতেও কম মূল্যবান এই পাথরটি।
উসমান জিগেশ করলেন, কেমন করে বুঝলেন?
সাধু বললেন, দ্যাখো, এতে কোনো শিল্পগুণসম্পন্ন আকৃতি নেই। এটি ভালো ডিজাইনারের হাতেও পড়েনি। আর যদিও পাথর হিসেবে এটা ভালো, তবু এর উজ্জ্বলতা ও রঙ মলিন হয়ে গেছে।
উসমান হতাশ হয়ে বললেন, এটি কিন্তু আমার দাদা মারা যাবার আগে আমাকে দিয়ে বলেছিলেন, খুবই দামি পাথর। যার কাছে থাকবে তার কোনো ক্ষতি হবে না।
সাধু হসে উঠলেন। বললেন, একটা পাথরের অনেক ক্ষমতা, তাই না? তোমার নাই?
উসমান বললেন, আমার আর কিসের ক্ষমতা! থাকলে কীআর আপনার কাছে আসি?
কেন আসো? ক্ষমতার জন্য?
তা নয়তো কি? সবাই তো ক্ষমতালাভের জন্যই আপনার কাছে আসে।
তোমার কি তাই মনে হলো এতদিন ধরে? তাহলে তুমি বিষয়টি ধরতে পারোনি একেবারে। আশপাশ দিয়ে ছুটে গেছে।
উসমান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন, কি বিষয় সাধুজি?
না, কিছু না। তোমাকে বলে লাভ নেই। একটা পুরনো পাথরকে যেভাবে ধরে রেখেছো, ঠিক সেভাবেই ধরে রাখে মানুষ পুরনো মূর্তি। এটা ভালোবাসার বা ভক্তির টানে না, আসক্তির টানে। তোমার ভেতরে প্রবল আসক্তি রয়েছে এর প্রতি। তুমি ভাবো, এটা তোমাকে রক্ষা করবে বিপদ-আপদ থেকে। যা তোমার একটা ভুল ধারণা। কিন্তু তুমি এর ভেতর দিয়ে একটা শক্তি পাচ্ছ, তাই তোমার ভেতর সাহস আছে, শক্তি আছে সবকিছুর মুখোমুখি হবার। এখন আমি যদি তোমাকে প্রকৃতই পাথরের শক্তি সম্পর্কে ধারণা দিতে যাই, তোমার সে শক্তির জায়গাটিতে টান পড়বে, দুর্বল হয়ে পড়বে তুমি।
উসমান জিগেশ করলেন, সে কেমন কথা সাধুজি! তাই বলে কি আপনি সত্য বলবেন না?
বলবো, কিন্তু সে সত্য যে তোমার ভেতরের সত্যকে আঘাত করবে, তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে, হতাশাগ্রস্ত করবে।
কীসব কথা বলেন না, মাথা ঘুরে যায় একেবারে! আমি তো খুব সাধারণভাবে বিষয়টি আপনার কাছে খুলে বললাম, দেখালাম। এখন দেখছি এতে উল্টো ক্ষতিই হলো আমার।
সাধু বড় চোখ করে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরপর বললেন, হ্যাঁ তাই হবে। তুমি একটি পাথরে যতটা ভরসা করছ, ততটা নিজের ওপর নেই। পাথরটির গুণাগুণ তালাশ না করে একে ধারণ করো, আসক্তি থেকে নয়, ভালোবাসা থেকে। দেখবে তোমার মঙ্গল হবে।
উসমান বললেন, সে তো করছিই সাধুজি। এখন কেবল আপনার কাছ থেকে এর পরিচয়টা জানতে পারলে মঙ্গল।
দ্যাখো উসমান, মঙ্গল-অমঙ্গলের বিষয় নির্ভর করছে তোমার নিজের ওপর। পাথরটি যদি একটা সাধারণ পাথরও হয়ে থাকে, তবুও আমি বলবো, তোমার নিজের ভেতরের প্রেরণাশক্তিই এর ভেতরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করবে। এখানে পাথর নয়, তুমি নিজেই মুখ্য।
উসমান জিগেশ করেন, আচ্ছা, লোকে যেমন মূর্তি গড়ে নিজেই পূজা করে, সেরকম?
হুম ঠিক তাই। এটা অত্যন্ত সাধারণ বুদ্ধিশুদ্ধির মানুষের কাজ। যারা একটা কিছু নিয়ে পড়ে থাকাকেই জীবনের সার্থকতা ভেবে বসে। কিন্তু তুমি যদি তাদের মতো না হও, যদি তোমার ভেতরে জীবনের গভীরতার স্পর্শ থাকে, যদি তুমি জীবনকে ভেতর থেকে দেখতে চাও, তবে নিশ্চয়ই তোমাকে পাথরটিকে পেরুতে হবে। ঠিক যেমন সাধক মূর্তিকে পার হয়। তোমাকে কথাগুলো বলছি, যদি তোমার বোঝার ক্ষমতা থাকে, কিংবা যদি নাও থাকে, কথাগুলো অন্তরের সেই সত্যকে জানান দেয়; যে সত্যকে তুমি দেখতে পাও না। এই যেমন ধরো, তোমার ভেতর এই বাসনা আছে যে, এই পাথরটির গুণ বিচার করে এটিকে তুমি যোগ্যভাবে ব্যবহার করবে। কিন্তু তুমি নিজেই যে সেই গুণে গুণান্বিত হয়ে আছ, তোমার ভেতর পাথরে যা নেই তার প্রতিবিম্ব শোভা পাচ্ছে, সেটা দেখতে পাচ্ছ না।
এতক্ষণ পাশে উসমানের স্ত্রী সব কথা শুনছিলেন। এবার তিনি হেসে উঠে বললেন, কী বলবো সাধুজি! আপনার কথার মাঝখানে কথা না বলে পারছি না। উসমানকে আমি এই পাথর থেকে বের করতে পারছি না। পাথরচাপা হয়ে আছে সে।
সাধু বললেন, তা নয় মা, এটা একটা পর্যায় জীবনের। সে তো পাথরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছে। যে পাথরের প্রাণ সে নিজেই। এই সত্যটি না বোঝা পর্যন্ত সে নিজেকে চিনতে ভুল করবে।
উসমান পাথরটি হাতে নিলেন। চোখের নিমেষে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন পদ্মফুলের ডোবায়। বললেন, আপনার কথা আমি ঠিক ভালো করে বুঝিনি সাধুজি। কিন্তু কথাগুলো আমার ভেতর একটা শক্তি দিয়েছে।
সাধু জিগেশ করলেন, কি শক্তি?
উসমান বললেন, ছুঁড়ে ফেলার।