আকাশপরী

ইকবাল হাসান

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৯

গোপীবাগ আড়াই লেনের ৩০ নম্বর বাড়ির ১৩তম ভাড়াটে আবদুল হাদী বাজারে যাচ্ছিল। ঘটনাটা তখনই ঘটল। ভাগ্যিস মাথার উপর ছাতা ছিল তার। সকালবেলা, তখনো তেজি হয়ে ওঠেনি রোদ। আর এই সকাল-সকাল বাজারটা সেরে ফেলতে পারলে জান বাঁচে আবদুল হাদীর। দুপুরে ঘর থেকে বেরুনোর কোনও উপায় নেই, আসমান থেকে নেমে আসে গজব। আগুনের হলকায় যেন হাড়-মাংস আলাদা হবার জোগাড়। ভাগ্য ভালো যে, বুদ্ধি করে ছাতাটা নিয়ে বেরিয়ে ছিল। নইলে কাকের গু সরাসরি ল্যান্ড করতো আবদুল হাদীর মাথার ঠিক মাঝখানে— যেখানটায় চুল উঠে গিয়ে রীতিমতো একখানা আয়ল্যান্ড তৈরি হয়েছে ইতোমধ্যে। যেন চারদিকে পানি আর মাঝখানে ছোট্ট একখানা বালুচর, মাওয়া হয়ে বরিশাল যাবার পথে এ ধরনের আয়ল্যান্ড চোখে পড়েছে তার।

 

আয়নার সামনে ইদানীং যখনই দাঁড়ায়, মন খারাপ হয়ে যায়। পাড়ার লোকেরা আর ক’দিন পরই তাকে চান্দিছিলা ডাকতে শুরু করবে। কে কী নামে ডাকবে তাকে— ও নিয়ে অবশ্য তার কোনও মাথাব্যথা নেই। তবে দুনিয়ায় এত জায়গা থাকতে কাউয়ার বাচ্চাকে প্রাত্যহিক কাজ সারার জন্যে আবদুল হাদীর মাথাকে বেছে নিতে হলো কেন, এই ভাবনা তাকে কিছুক্ষণ ভাবিত রাখে। এ ধরনের ঘটনা যে প্রথম ঘটলো তা নয়, এর আগেও একদিন, মতিঝিলে বন্ধুর অফিসে যাবার সময় তিন অথবা চারতলার বারান্দা থেকে পলিথিনের একটা পোটলা এসে পড়ল তার মাথার উপর। সেদিনও মাথার উপর ছাতা ছিল বলে রক্ষে। পোটলাটি ছাতার উপর থেকে ছিটকে তার পায়ের সামনে, অতঃপর ল্যান্ড করলে অনিচ্ছাকৃতভাবে আবদুল হাদীর পা পড়ে যায় তার উপর এবং পায়ের চাপে পলিথিনের বুক ফেটে মুরগির নাড়িভুঁড়ি, তরিতরকারির বর্জিত অংশ ইত্যাদি বেরিয়ে পড়ে। মাথার উপর থেকে ছাতা সড়িয়ে, যদিও তখন টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছিল, তিন ও চারতলার বারান্দার দিকে তাকিয়ে সে দ্যাখার চেষ্টা করে, এমতো সকালে এরকম একখানা কুকর্ম কার হাতে সম্পাদিত হলো! কিন্তু তিন বা চারতলার কোনও বারান্দায়ই কাউকে দ্যাখা গেল না।

 

আজও তাই হলো। ছাতাটা সরিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে আজ অবশ্য কালপ্রিটকে দেখতে পেল সে, ইলেকট্রিকের তারের উপর নিশ্চিন্তে বসে আছেন তিনি। এই কুকর্মটির জন্যে তাকে মোটেই অনুতপ্ত মনে হলো না। সেতো একটি কাক মাত্র, কাউয়া— আমরা মানুষেরা নিরীহ প্রকৃতির মাথার উপর, সভ্যতার মুখে রোজই তো হাগামুতা করে চলেছি। সে জন্যে আমরা কি কখনো অনুতপ্ত? কখনো নয়। এ নিয়ে আর বেশি কিছু এই মুহূর্তে ভাবতে চাইল না আবদুল হাদী। বরং মাথা নেড়ে এতোদসংক্রান্ত অর্থাৎ কাক মানুষ সভ্যতা নিয়ে ভাবনাটি এখনই তাড়াতে না পারলে এই ভাবনাখানাই উল্টো তাকে তাড়া করে বেড়াবে দিনরাত।
হঠাৎ তার মনে পড়ে বাজারে যাবার কথা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী ছাইপাশ ভাবনা হচ্ছে, কিন্তু কাকের গু মাথায় নিয়ে তো বাজারে যাওয়া যায় না, অতএব সিদ্ধান্ত নেয় ছাতাটি বন্ধ করার। এবং এই কাজটি করার ফলে ছাতার ঊর্ধ্বাংশে কাকের গু ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটি চিন্তায়ও আসে না আবদুল হাদীর।
দ্রুত বাজারের দিকে হাঁটতে থাকে সে।

দুই.
আবদুল হাদীকে বাজারে পাঠিয়ে আজ কিছুতেই যেন স্বস্তি পাচ্ছে না গুলনাহার বানু। যতবারই তাকে বাজারে পাঠানো হয়েছে একটা না একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ঘরে ফিরেছে মানুষটা। আজ আবার কী ঘটাবে, গড নোজ। এখনো আসছে না দেখে গুলনাহারের টেনসান বেড়ে যায়। সে কিছুক্ষণ পরপরই বারান্দা থেকে উঁকি দিয়ে বড় রাস্তার মানুষজনের মধ্যে আবদুল হাদীকে খুঁজে দ্যাখার চেষ্টা করে। এবং ভাবে যে, কাজটা বোধহয় ঠিক হলো না, আসলে তার নিজেরই উচিত ছিল বাজারের ঝামেলাটা সামলানো। বাজারে যেতে কোনও আপত্তি নেই তার। আজকাল তো নিউমার্কেট, গুলশান, বনানী, উত্তরার বিডিআর বাজারে মেয়েরা হরহামেশা যাচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে টেকনিক্যাল সমস্যা হলো— এক, গুলনাহার বানু মেয়েমানুষ এবং দুই, দেখতে ভারতীয় ছবির নায়িকাদের মতো, অপ্সরী। বাজারে গেলে পুরুষ মানুষগুলো খুবই অশ্লীলভাবে তাকিয়ে থাকে, যেন মনের আসল বাসনাটি চোখ দিয়েই পূরণ করে নিচ্ছে। অনেকে ইচ্ছে করে শরীর ঘেঁষে দাঁড়ায়, অনেকে গায়েপড়ে আন্তরিকতা দ্যাখায়। গুলনাহারের ভালো লাগে না এসব। এরা কবে মহিলাদের মানুষ বলে ভাবতে শিখবে?
আবদুল হাদীর দ্যাখা নাই পাক্কা তিন ঘণ্টা। অথচ বাজার সারতে এক ঘণ্টার বেশি লাগার কথা নয়। বারান্দার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে গুলনাহার। এর আগেও এ রকম হয়েছে। একবার তো বাজার থেকে ফিরে এসেছিল রক্তাক্ত অবস্থায়। আবদুল হাদী নাকি কিছুই বুঝতে পারেনি, কোথা থেকে কী হয়েছে। সে একটি ইলিশের দাম শোনা মাত্র, ‘গুষ্টিমারি তোর ইলিশের’ বলে সজোরে মাছের ডালায় লাথি ছুঁড়েছিল এবং যার ফলে কয়েকটি ইলিশ প্রায় উড়ে গিয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছিল— এপর্যন্ত স্মরণে ছিল তার। পরেরটুকু যেন স্বপ্নে ঘটেছিল, অবিশ্বাস্য এবং স্বপ্নে ঘটেছিল বলেই পরের ঘটনাটি তাকে স্পর্শই করতে পারেনি— এমন একধরনের বোধ হয়েছিল তার। ছেঁড়া পাঞ্জাবি, রক্তাক্ত অবয়ব, কাটা ঠোঁট দেখে প্রায় চিৎকার করে উঠেছিল গুলনাহার বানু। সেদিন ১৬ নম্বরের মকসুদ সাহেব দেখেছিলেন বলে প্রাণে বেঁচে গেছে আবদুল হাদী, নইলে মাছ বিক্রেতারা একজোট হয়ে মেরেই ফেলতো তাকে।
আর একবার, সেদিন বৃষ্টি ছিল খুব, গুলনাহারের ইচ্ছে হচ্ছিল না বাজারে যেতে। আবদুল হাদীকে পাঠিয়েছিল, হাতে বাজারের লিস্ট আর পেনসিল দিয়ে। যাতে লিস্ট দেখে দেখে বাজার করা তার জন্যে সহজ হয়। কারণ, গুলনাহারের ধারণা, ছুই মনে রাখতে পারে না আবদুল হাদী। হয়েছিলও তাই, বাজার নিয়ে বাসায় না এসে আবদুল হাদী সোজা চলে গিয়েছিল মোহাম্মদপুর, গুলনাহারের বান্ধবী সোনিয়াদের বাসায়। আর সোনিয়া সকালবেলা তার বাসার দরজার সামনে আবদুল হাদীকে বাজার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যেন আকাশ থেকে পড়ে।
‘আপনি, এত সকালে কোত্থেকে?’ আবদুল হাদীর মুখে কোনও কথা ফোটে না। যেন সে নিজেও বিস্মিত কম হয়নি, এমন একটা ভাব তার মুখে দেখতে পায় সোনিয়া। নিজেকে সামলে নিয়ে আবদুল হাদীকে ঘরে এনে বসায়। তারপর ভিতরে গিয়ে ফোন করে গুলনাহারকে, ‘বানু তোর স্বামী সাতসকালে দুই ব্যাগ বাজার নিয়ে আমার বাসায় হাজির, মাথাটা বোধ হয় গেছে। এবার পাবনা নিয়ে যা...।’ পাবনা নিয়ে যাবার কথা শুনেই মন খারাপ হয়ে যায় গুলনাহারের, সে এক কাপড়ে ছুটে আসে মোহাম্মদপুর। এসে দেখে, দু’হাটুর মাঝখানে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বসে থাকা আপাত উদভ্রান্ত মানুষটি তাকিয়ে আছে জানালার বাইরে। আবদুল হাদীকে নিয়ে নীরবে বেরিয়ে আসে সে।
গুলনাহার বানু আজ যখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে এইসব ঘটনা স্মরণে আনছিল অথবা আবদুল হাদী আপন ভাবনায় নিজের স্ত্রী বলে ভাবিত গুলনাহারকে এভাবেই (তাকে নিয়ে) উদ্বিগ্ন হতে দেখছিল, ঠিক তখন বাজারে আবদুল হাদীকে দেখতে পায় ২২ নম্বরের তৈয়ব উদ্দিনকে, দেখে যে, তার তখনো কিছু কেনা হয়নি। কাঁচাবাজার, ছোট আকারের। অনেক সময় অনেককিছু পাওয়াও যায় না। পাশ দিয়ে রেললাইন চলে গেছে নারায়নগঞ্জ। বাজারের ভিতর কোথাও কোথাও পানি জমে নোংরা ফ্যাচফ্যাচে কাদামাটি, তার উপর কাঠের তক্তা বিছিয়ে হাঁটাচলার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
আর আবদুল হাদীর ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিপত্তিটা এখানেই ঘটে। সে তক্তার মাঝখানে পা রাখতেই দু’পাশ থেকে ফিচ্ করে জলকাদা উঠে এসে নোংরা করে দ্যায় তার স্যান্ডেল ও প্যান্টের নিম্নাংশ। হাঁটতে গিয়ে যা এখন খুবই অস্বস্তির কারণ হয়

তিন.
গুলনাহারের দেয়া বাজারের লিস্ট ও পেনসিল ঘুমিয়ে থাকে তার বুক পকেটে। আর সে একহাতে ছাতা ও অন্যহাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে আরো কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে, তার কিছুই কেনা হয় না। বাজার থেকে বেরিয়ে উল্টোপথে রেললাইন ধরে হাঁটতে থাকে একসময়। হাঁটতেই থাকে এবং ধীরে ধীরে রেললাইনের দু’পাশের ঘরবাড়ি, দোকানপাট, সাইনবোর্ড, ডোবা, ড্রেন, তালগাছ, ল্যাম্পপোস্ট সবই অচেনা হয়ে ওঠে। কিছুই পরিচিত মনে হয় না তার। এক সময় ক্লান্তি বোধ করে সে।
রোদ উঠেছে। এই গ্রহের দিকে আগুনের হল্কা ছুঁড়ে দিচ্ছে সূর্য। গরমের তীব্রতা অনুভব করে সে, তখন ছাতা খোলা জরুরি হয়। আবদুল হাদী ভুলে যায় যে, ছাতার উপর কাক মলত্যাগ করেছিল সকালবেলা বাজারে আসার সময়।

চার.
গুলনাহারের পুরোদিনের প্ল্যান যেন মাটি করে দ্যায় আবদুল হাদী, এমন মনে হয় তার। আজ ছুটির দিন ছিল, ভেবেছিল, সকাল সকাল রান্নাবান্না আর ঘরের কাজ শেষ করে বিকেলের দিকে বেরুবে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আনিসুর রহমানের কাছে যাবে, তিনি বসেন বড়মগবাজার। অষুধও শেষ হয়ে গেছে আবদুল হাদীর, নোভা ওলানঝাপাইন ১৫ মিলিগ্রাম। এই অষুধটা বেশ কাজের। আবদুল হাদী অনেকটাই নরমাল এখন। মাঝখানে কিছুদিন জনতা ব্যাংকের মতিঝিল শাখাকে নিজের অফিস মনে করে বসে থাকতো, এখন আর করে না।
সংসারের সব ঝামেলা যেন গুলনাহারের উপর, নিজের দিকে তাকাবার সময়টুকু পর্যন্ত তার নেই। আহারে, গুলনাহারের কষ্টের কথা ভেবে ভেবে মাঝে মাঝেই খুবই মন খারাপ হয়ে যায় আবদুল হাদীর। ভাগ্যিস তাদের কোনও বাচ্চাকাচ্চা নেই, থাকলে যে কী হতো, গুলনাহার বানু কী তা ভাবতে পারে? এক আবদুল হাদীই তাকে দশ বাচ্চার ঝামেলা দ্যায়। তবু তাকে গুলনাহার খুব ভালোবাসে এটাই তার জীবনের জন্যে অনেক।
আজকাল একা একা বাইরে যেতে খুব ভয় আবদুল হাদীর। না বলে কিংবা গুলনাহার না বললে সে সচরাচর কোথাও বড় একটা যায় না। ঘরেই থাকে। অফিস থেকে ফিরে এসে যেন গুলনাহার দেখতে পায় আবদুল হাদী ঘরেই আছে। আবদুল হাদীর ধারনায় গুলনাহার যখন তাকে নিয়ে এইসব ভাবছে কিংবা ভাবতে পারে, ঠিক তখন দরজায় হালকা টোকার শব্দ হয়। খুলে দ্যাখে, বাজার হাতে আবদুল হাদী। ঘামে ভিজে একাকার, অনেকটা উদভ্রান্ত।
‘কোথায় গিয়েছিলে? এত দেরি হলো কেন? আমার বুঝি চিন্তা হয় না?’
আবদুল হাদী গুলনাহারের প্রশ্নের উত্তরে বিড়বিড় করে বলে, ‘বাসাটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।’
‘আহারে সোনা, আমি আর কোনও দিন তোমাকে বাজারে পাঠাবো না।’ দু’হাত বাড়িয়ে আবদুল হাদীকে বুকে টেনে নেয় পরম মমতায়, আর আবদুল হাদী গুলনাহারের সেই মায়া-আলিঙ্গনের ভিতর পাখির মতো লুকিয়ে থাকে। কতদিন তাকে কেউ এভাবে জড়িয়ে ধরেনি! কত দিন!
এক সময় সে টের পায়, পায়ে কাদাজল শুকিয়ে চটচট করছে। সে ছাতা হাতে বাথরুমের দিকে যাবার উদ্যোগ নিতেই গুলনাহার এগিয়ে আসে, ‘কী ব্যাপার, তুমি বাথরুমে ছাতা নিয়ে ঢুকছো কেন?’
আবদুল হাদী ধরা পড়ে গেছে, এমন মনে হয় তার। সে বলে, ‘এমনি।’
‘এমনি মানে?’
গুলনাহারের চোখের দিকে তাকাতে পারে না সে। অতএব অন্যদিকে তাকিয়ে বলে, ‘সকালে বাজারে যাবার সময় ছাতার উপর কাক...’ কথাটা শেষ না করেই বাথরুমের আড়ালে চলে যায় আবদুল হাদী, আর ভাবে, বাকিটা গুলনাহার ঠিকই বুঝে নিতে পারবে।

পাঁচ.
নীল আলো জ্বলছে, ক্লান্ত গুলনাহার বানু সেই নীলাভ আলোর ভিতর ঘুমে অচেতন। একটা হাত ঝুলে আছে খাটের বাইরে, শাড়ি উঠে আছে হাঁটুর কাছে, বুক আঁচলহীন— এতটাই আলুথালু অবস্থায় কাৎ হয়ে শুয়ে আছে গুলনাহার, দেখে আবদুল হাদীর মনে হলো, যেন আকাশপরী। যাদের সে মাঝেমাঝেই তার চারপাশে নৃত্যরত অবস্থায় দ্যাখে। গুলনাহারের সারা শরীর থেকে যেন ঠিকরে পড়ছে অপার্থিব আলো, নীল এত নীল কোত্থেকে এলো ঘরে? আর এখন ঘরের ভিতর ছড়িয়ে পড়া সে আলোয় ভেসে যাচ্ছে তার হাত-পা-চোখ-নাক-বুক, সবকিছু— ঠিক যেন স্বপ্নে দ্যাখা পরীদের মতো।
আবদুল হাদী পরম আদরে খাটের বাইরে ঝুলে থাকা গুলনাহারের হাতখানা বিছানার উপর তুলে দ্যায়। তারপর নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
রাতের তৃতীয় প্রহরে এখন ফ্যাকাশে চাঁদ আকাশে। ঘোলাটে চারদিক, কুয়াশা নেমেছে খুব গাঢ় হয়ে। আবদুল হাদী রেললাইন ধরে হাঁটতে থাকে সেই গাঢ় কুয়াশার ভিতর। এই গভীর মগ্ন কুয়াশায় সে যখন কিছুই শনাক্ত করতে পারে না তখন তার হঠাৎই মনের মধ্যে উঠে আসে গুলনাহার, তার আকাশপরী। মনে হয়, ঘরে ফিরে যাবার কথা। কিন্তু তার চারপাশ ঘিরে নৃত্য করছে যেন কুয়াশার গাঢ় অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারের গভীরে যেতে যেতে আবদুল হাদী দেখে, গাঢ় কুয়াশার হৃদয় ফুঁড়ে একটি একাকী হাত। মমতা মাখানো কুয়াশা জড়ানো মায়াবী কোমল হাত, কুয়াশার মধ্যেই ভেসে বেড়াচ্ছিল, যেন কতকালের চেনা, সে দ্যাখে, আকাশ সমান দীর্ঘকায় অই কোমল হাতখানা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে গুলনাহার। আবদুল হাদী চিনতে পারে— এই সেই হাত, যা ঝুলে ছিল বিছানার বাইরে, যা সে তুলে রেখে এসেছিল শয্যায়, আবদুল হাদী নিঃশব্দে হাত ধরে অধিকতর নিঃশব্দে রেললাইনের মাঝপথ দিয়ে কুয়াশার ভিতর এগুতে থাকে। সহসা তার মনে হয়, কুয়াশা নয়, মেঘের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে যেন, কিন্তু বুঝতে পারে না গুলনাহারের হাত ধরে কোথায় যাচ্ছে সে! হাঁটতে হাঁটতে শরীর শিথিল হয়ে আসে তার, চোখ বুজে আসে ঘুমে।
রেললাইনের উপর মাথা রেখে সে ঘুমিয়ে পড়ে একসময়।

ছয়.
আর শেষমুহূর্তে ঘুমের মধ্যে তার চুলের ভিতর অই মায়াবী হাতের পাঁচটি আঙুলের কোমল ছোঁয়া অনুভব করলেও গুলনাহার বানু বলে যে, তার জীবনে কেউ কোনও দিন ছিল না— এই সত্য অজানাই থেকে যায় আবদুল হাদীর।