অ্যান্টিবায়োটিক: মৃত্যুর ফাঁদ
ডা. রাজীব হোসাইন সরকারপ্রকাশিত : জুলাই ১৮, ২০১৯
বাজারের সব দুধের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে। এই মুহূর্তে সরকারি এক ঘোষণায় সবক`টা কোম্পানিকে জরিমানা করে রাস্তায় দুধ ঢেলে ফেলা যেত।
ভয়ের ব্যাপার হলো, জরিমানার পরিমান যদি মানুষের ওজনে স্বর্ণও দেয়া হয় তবুও ব্যালেন্স হবে না। অ্যান্টিবায়োটিক কি জিনিস, আপনি নিজেও জানেন না। বাজারের দোকানদাররাও জানে না। জানে হতভাগা বাংলাদেশি ডাক্তাররা।
প্রত্যন্ত চর থেকে রোগী এসেছে। চিকিৎসায় ভালো হচ্ছে না। দেখা গেল, সবগুলো অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট। হয়তো একটাও কাজ করছে না। কিংবা একটা কাজ করছে।
সেই অ্যান্টিবায়োটিকের দাম আটশো থেকে ১২০০ টাকা করে। দিনে ৩-৪টা কিনতে হয়। টানা সাতদিন। একটা গ্রাহক পেলেই কোম্পানির ২১-২৪ টা বিক্রি হবে। এই আশায় মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভরা হাসপাতালের ভেতরে ঘোরাঘুরি করে। ডাক্তারদের নাম্বার দিয়ে যায়। ছাড় হবে, হ্যান হবে, ত্যান হবে টাইপের বক্তব্য। এরপর দরিদ্র লোক দিনের পর দিন বাড়ি থেকে টাকা আনছে আর চিকিৎসা করছে। ভয়ানক দৃশ্য!
আর এভাবে সবকিছুতেই অ্যান্টিবায়োটিক পেতে থাকলে আপনি কোথায় যাবেন? মাংসে অ্যান্টিবায়োটিক, দুধে অ্যান্টিবায়োটিক, ঝালমুড়ির মতো অ্যান্টিবায়োটিক সকাল-দুপুর-রাত খাচ্ছে মানুষ। সবাই জানে, অল্প বোঝে কিন্তু কেউ সচেতন হয় না। সব দুধে অ্যান্টিবায়োটিকের খবর আসার সাথে-সাথে সবার উচিত ছিল একযোগে বলা, দুধ কেনা বন্ধ। আর খাব না। কাউকে খেতেও দেব না। দুধ দিয়ে বানানো সকল খাবার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ।
তেমন ঘটে নাই। সবাই ধর্ষণ নিয়ে চিন্তিত, ভয়ে আছে কিন্তু কেউ ভাবে না গোড়া থেকে একটা পরিবর্তন দরকার। কোনো ফেসবুকার বা দল যদি ঘোষণা দেয়, পাঠ্যবইতে যৌনশিক্ষা বন্ধ করে দেয়া হোক। এটা মুসলিম দেশ। এই দুটো বাক্য দিয়েই সব মানুষকে এক ছাদের নিচে আনা যাবে। সবাই শীতের শেয়ালের মতো একসাথে হুক্কাহুয়া করবে। কেউ বুঝতেও চাইবে না, যৌন শব্দটা ভারি হলেও শিক্ষাটা অনেক হালকা ধাঁচের। সেখানে মাসিক নিয়ে বেসিক শিক্ষা দেয়া হয়। আমাদের সমালোচনার বেসিক ভালো, জ্ঞানের কোনো বেসিক নাই।
এদেশে সব বন্ধ হবে কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যাপারটা নিয়ে কিছু হবে না। বিষ খেলে মানুষকে বাঁচানো যায়, সাপে কাটলে বাঁচানো যায় কিন্তু দুধের মধ্যে অদৃশ্যমান অ্যান্টিবায়োটিক এভাবে খেতে থাকলে আপনাকে বাঁচাবে কোন দাওয়া? আপনি কোটিপতি? দেশের মন্ত্রী? বিশাল ব্যবসায়ী, অনেক শিক্ষিত? অ্যান্টিবায়োটিক জীবনে একটাও খাননি? দুধও খান না? তবুও বাঁচতে পারবেন না রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার কবল থেকে। ইস্পাতের সিন্দুকে লুকিয়ে থাকুন আর স্টেরাইল কাঁচের ঘরে থাকুন, তবুও রেহাই পাবেন না। এই জিনিস তো বাতাসে, মাটিতে, পানিতে, খাবারে সবকিছুতেই ছড়িয়ে যাচ্ছে।
মাঝেমাঝে আফসোস হয়, অ্যান্টিবায়োটিক আর রেজিস্ট্যান্সি নিয়ে জানার এতকিছু আছে কিন্তু সুযোগ কই? কেউ জানার আগ্রহ পর্যন্ত দেখায় না। এজন্য উইকিপিডিয়া থেকে মানুষ ফেসবুকে বেশি সময় কাটায়। সপ্তাহখানেক আগে একটা গবেষণার লিংক নিউজফিডে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কে একজন ব্যাকটেরিয়াদের কথা শোনার প্রযুক্তি আবিষ্কার করছে। অমনি কেউ একজন ছড়িয়ে দিল রেজিস্ট্যান্সি নিয়ে ভয় নাই। আসলেই কি তাই?
আপনাকে কীভাবে বোঝানো যায়, রেজিস্ট্যান্সি সহজ জিনিস নয়। এটার প্রতিরোধ এত সহজ নয়। প্রতিরোধ আসতে আসতে গণহারে মরতে শুরু করবে মানুষ। একবার হাসপাতালে গেলে আর ফিরেও হয়তো আসবে না। এই মানুষগুলোর জন্য তো সবার আফসোস কাজ করার কথা। আমি-আপনি অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সি নিয়ে জানি। বাকিরা জানে না। তাতে আমাদের ভয় নেই? ভয় তো আরো বেশি। ব্যাপারটা তো ছোঁয়াচে। আপনি-আমি ভালো আছি, বাকিরা তো বাতাসে-জলে-স্পর্শে ছড়িয়ে দিচ্ছে। আপনি-আমি কীভাবে রেহাই পাব?
আমার ফ্রেন্ডলিস্টের সত্তরভাগ মানুষ ডাক্তার। আমি ইচ্ছেকৃতভাবে সেটা বিশ ভাগে নামিয়ে এনেছি। কারো প্রতি শত্রুতা থেকে আনফ্রেন্ড করিনি। আমার মনে হয়েছে, এমন বিচিত্র সব মৃত্যু আর রেজিস্ট্যান্সির ছবি আর নিউজ দেখতে দেখতে আমি ভয় পাচ্ছি। ক`টাদিন মাত্র বাঁচব। মানুষ কথা শুনছে না, মানুষ বাজারের প্রোডাক্ট বর্জন করতে পারছে না, তাদের নিয়ে আর কত ব্যস্ত থাকব। তারচেয়ে কয়েকদিন উটপাখির মতো বালুর নিচে মাথা ঢুকিয়ে রাখি। নিজেদের বিপন্ন অস্তিত্ব দেখার সাহস আমার নাই। এত আতঙ্ক নিয়ে দিনরাত পার করার মানে নেই।
খুব অসহায় লাগে যখন আমার নিউজফিডে দেখি, মাত্র দুইদিনের বাচ্চা। সবক`টা অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। তার চিকিৎসা নাই। কয়েকদিনের মধ্যেই মারা যাবে। তাদের পিতামাতা কী কখনো ভেবেছিল একদিন তাদের সদ্য জন্ম নেয়া পরীর মতো বাচ্চা দুইদিনের মধ্যে ক্যান্সার-এইডসের চেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার নিয়ে মারা যাবে? কী দোষ বাচ্চাটার? সে তো অ্যান্টিবায়োটিক খায়নি, সে তো জানেও না পৃথিবীতে সে জন্ম নিয়েছে। এই পৃথিবীর আলো-বাতাস আর বিবিধ সৌন্দর্য সে তো একদিনও উপভোগ করতে পারল না। তাহলে কেন সে এভাবে জন্মের সাথেসাথে চলে যাবে?
আমি কী বানিয়ে বলছি? আমি কী লেখকসত্তার জোরে এভাবে পেঁচিয়ে আপনাকে ম্যানিপুলেট করছি? অ্যান্টিবায়োটিক কি মিথ? অনেক প্রশ্ন জাগছে সত্য মিথ্যা নিয়ে?