অ্যাকটিভিস্টদের গ্যাঞ্জাম

মঈনুল ইসলাম তুহিন

প্রকাশিত : অক্টোবর ০১, ২০১৯

`মতাদর্শের বিরুদ্ধে বলতে যাইয়া ব্যক্তি আক্রমণ`র বিপক্ষে দাঁড়াইছেন একজন অ্যাকটিভিস্ট। বেশ কিছুদিন যাবত সেই `ব্যক্তি আক্রমণ`র বিপক্ষের অ্যাকটিভিস্টের সাথে `পক্ষে`র অ্যাকটিভিস্টদের গ্যাঞ্জাম। গ্যাঞ্জামের সারকথা হইলো, আলাপ ব্যক্তি আক্রমণেই আছে। কার বউ মোসলমান, কে কার বউরে ম্যারিটাল রেপ করছে, কার যন্ত্র কত ইঞ্চি, কার ফুটা কত বড়/ছোট, কে কি করে/খায়, কার বউ অতৃপ্ত, কে লুইচ্চা, কে মাগি, কে ব্যক্তিজীবনে সৎ, কে অসৎ, কে কার নুন খাইছে বাট গুণ গায় নাই, কে কারে চাকুরি দিছে— এইসবের ঘেরাটোপেই আলাপ আটকায়ে আছে। এর কোনোটা ব্যক্তি আক্রমণ আর কোনোটা `গঠনমূলক` আলাপ, আমার জানা নাই।

এই আলাপগুলা আমার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগলো দুইটা কারণে। প্রথমত, ব্যক্তিগত আর অব্যক্তিগতের যে সীমানা আমাদের সেক্যুলাররা বাইন্ধা দেন তাদের অপজিট নানান গ্রুপরে, ওনারা সেই সীমানা কদ্দুর মেইন্টেইন করেন, বা আদৌ বোঝেন কিনা, তার একটা হদিশ পাওয়া গেল এইখানে। কোনোটা ঠিক ব্যক্তিগত পরিসর আর কোনোটা সামাজিক পরিসর, কোনোটা মতের বিরোধিতা আর কোনোটা ব্যক্তি আক্রমণ— এই নিয়া নতুন নতুন সেক্যুলাররা তো গত প্রায় এক দশক ধইরাই অন-অফসহ অন্য নানা লাইনই গরম কইরা থুইছেন। তো ওনাগো যাপনে এই ধারণাগুলা কীভাবে ওয়র্ক করে, দেখতে পাইলাম।

দ্বিতীয়ত, এনারা দুটি পক্ষ, কীভাবে একে অন্যের ভিন্নমতরে জাজ করেন, মতের ভিন্নতারে এনারা কীভাবে দেখতে, দেখাইতে ও মোকাবেলা করতে আগ্রহী, তাও দেখতে পাইলাম।

তৃতীয়ত, গালাগালির ইস্যুটা দেখেন। গালাগালি ব্যক্তির চয়েজ, আমার এ নিয়া কিছু বলার নাই। কিন্তু গালাগালি বা অশ্লীল কথাবার্তার বিরুদ্ধে হামেশাই ওনাদের এলিগেশন দেখি, মানে `বাঙালি যুক্তিতে না পারলে গালিগালাজ করে` বা `মুশফিকের পোস্টের তলে যারা গালি দেয়, এরা কারা`-ধরণের কথাবার্তা। কিন্তু রুচিবাগীশ এই নয়া-নাস্তিকরাও যে শেষ পর্যন্ত আমাদের বাঙালি সমাজের লোকই, উর্ধ্বজগতের কোন প্রাণী নহে, সেইটা বোঝা গেল একটু-আধটু মনে হয়।

এমনে, আলাপের বিষয়টা গুরুতর। আমাদের এইখানে মডার্ন নাস্তিক আর পোস্টমডার্ন নাস্তিকদের একটা ভাগ তৈরি হইছে আসলে। মডার্ন নাস্তিক মানে, ব্লগে যারা নাস্তিকতা চর্চা করত, এখনো তাদের কেউ কেউ আছেন চর্চারত। পোস্টমডার্ন নাস্তিক গ্রুপটা তৈরি হইছে ২০১৩-র পরে আওয়ামী রাজনীতির প্রতিক্রিয়া হিশাবে। বাঙলাদেশে নাস্তিকতার চর্চা একদমই রাজনীতি-নিরপেক্ষ ছিল না কোনকালেই। ২০১৩ পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, এইদেশের নাস্তিকতার চর্চা, একটা এভারেজ লেভেলে, আওয়ামী রাজনীতিরে সার্ভ করছে, বাঙলাদেশে ইতিহাসের যে কনটেক্স বা বাইনারি তৈরি হইছে, ধর্ম বনাম অন্য কিছু (সেক্যুলারিজম কন বা অন্যকিছু কন), তা এই মডার্ন নাস্তিকদের চিন্তাপথ তৈরিতে সহায়তা করছে আগেই।

তো, এই নয়া কন্টেক্সটে, আওয়ামী রাজনীতির আল্টিমেট সফলতার আমলে, এর সর্বগ্রাসী জুলুমের প্রতিক্রিয়া হিশাবে পোস্টমডার্ন নাস্তিকতা ইভলব করছে। বিশ্বের পরিসরে ধর্মরে দেখাশোনার কায়দা-কানুনও নয়া শেপ পাইছে, পাইতেছে; ফলে নাস্তিকতার ক্ল্যাসিক ধর্মচিন্তার জায়গাগুলাও থিওরিটিক্যালি পাল্টাইছে। পোস্টমডার্ন নাস্তিকেরা বুঝতেছেন যে, মডার্ন নাস্তিকতা আসলে উগ্র ধর্মবিদ্বেষই ছিল মূলত, অন্তত এইদেশের কনটেক্সটে৷ ফলে ওনারা সেই জায়গাগুলারে অ্যাকোমোডেট করতেছেন। ধর্মের লগে আলাপের বাইনারি চিন্তার জায়গাগুলারে নতুনভাবে বুঝতে চাইতেছেন।

এইটা বাঙলাদেশের জন্য ভালো খবর অবশ্যই। কিন্তু মডার্ন নাস্তিকদের পুরান খাসলতগুলা এনারা এখনো পুরাপুরি বাদ দিতে পারেন নাই মনে হয়, পলিটিকাল জায়গাগুলায় ওনাদের চিন্তার রিফর্মেশন কিছু হইলেও, মনে হয় ওনারা প্রত্যেকেই এখনো চিন্তা-ভাবনা বা বুদ্ধিবৃত্তিক মোকাবেলার কোর জায়গাগুলাতে পুরান খাসলতেই রইয়া গেছেন। সেই মডার্নিটি, ব্যক্তি-বিচ্ছিন্নতার কড়া ফিলিংস। ওনাদের চিন্তা এনাফ পলিটিকাল হইয়া ওঠে নাই এখনও মেবি। এইটা হয় চিন্তার ডিলেমার কারণে, বাঙলাদেশের পোস্টমডার্ন নাস্তিকেরা চিন্তার ওই ডিলেমাটা ফেস করতেছেন এখন।

বাঙলাদেশে একটা সুন্দর ও আশাবাদী পলিটিকাল মীমাংসা বা পরিসরের জন্য, আমি এই পোস্টমডার্ন নাস্তিকদের দৃষ্টিভঙ্গিগুলারে ইন্টারেস্টিং মনে করি, আগের ব্লগ যমানার নাস্তিকদের সেই তুলনায় ব্যাকডেটেড মনে হয়। কিন্তু, চলমান বিতর্কে সঙ্গত কারণেই, সেই ইন্টারেস্টটা নাই। নাই, কারণ ওনাদের কারুরই আসলে কোন আর্গুমেন্ট নাই। ওনাদের যা আছে, আধা ইঞ্চি বা ফুটা— তা তো সকলেরই আছে মেবি।