অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর তিনটি কবিতা

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৮, ২০২০

কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত আর নেই। মঙ্গলবার রাতে তিনি মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। চার দশক ধরে জার্মানির বাসিন্দা কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। সেখানে স্ত্রী এলিজাবেথের সঙ্গে তিনি থাকতেন। স্থানীয় সময় রাত ৯টার দিকে তিনি মারা যান। বেশ কিছু দিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন কবি। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিশেবে তার লেখা তিনটি কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

এক জানালা রাত্রি আমার

এক জানালা রাত্রি আমার কাটল কেমন করে
মোগলসরাই প্যাসেঞ্জারে বৃষ্টি নামল তোড়ে।
বৃষ্টি নামল, ভীরু ধানক্ষেত ভালোবাসার মতো,
আলের পথে আলের পথ আলিঙ্গনরত।

এক জানালা রাত্রি আমার কাটল কেমন করে
বৃষ্টি থামল, সাঁকোর তলায় এই পৃথিবী ক্রোড়ে
মা জননী বসে আছেন, চোখের সামনে খালি
শহরে কাজ নিতে পালায় বলাই বনমালি।

বলাই বনমালী সুবল শ্রীদাম সুদাম শেষে
রমেন নরেন পরেশ হলো শহর ভালোবেসে।
মধ্যমগ্রাম হালিশহর রামপ্রসাদী সোনা
চুরির ভয়ে আব্‌জে নিল চব্বিশ পরগণা।

‘মা গো ভীষণ ঘুম পেয়েছে আমায় রক্ষা করো’
বলতে বলতে সামলে নিলাম, আকাশ জড়োসড়ো,
আকাশ আমার বুকের নিচে মাথা গুঁজবার আশায়
জড়ো হলো। কে আর তবু একভিড় লোক হাসায়?

দু’হাত থেকে ছিট্‌কে গেল কাঁপা হাতের কুপি,
চোখ-ধাঁধানো আলো ছুঁড়ল কে এক বহুরূপী,
এক আলালের ঘরের দুলাল গাড়ির মধ্যে জেগে
বাংলাদেশের পাতা ছিঁড়ল ভূগোলের বই থেকে।

যন্ত্রযুগ

পুরোনো দিনের গান করি যেই ত্রিকূট পাহাড়ে
মৌনী সন্ন্যাসী যত আনন্দ ঔৎসুক্যে মাথা নাড়ে;

রোপওয়ে ধরে যত আরোহীরা ওঠে আর নামে
রজনীকান্তের গানে অবনত হয়েছে প্রণামে;

কিন্তু বিদিশার হাতে স্মার্টফোন ছিল না বলেই
সে বলে এসব গান একসঙ্গে আছে আর নেই

নবনীতা বলে ওঠে, `বিদিশা, এ এক দুর্লক্ষণ,
সেভ করা গেল না হায়, অলোকদার স্বরের স্বনন।`

সইমেলা আর দুই সতীর্থ

এমন তো নয় দু`বন্ধু এই জীবনে প্রথম
উদ্বোধনের প্রদীপ জ্বালাতে এখানে এসেছি
—না এলে দারুণ অনর্থ হতো, বলা বাহুল্য,
নবনীতা সবই করে দিত খুব লণ্ডভণ্ড—
তবু দুজনেই কমবিস্তর নার্ভাস আছি,
চৌদিক থেকে সইমেলা জুড়ে অঙ্গনা যত
আমাদের এই অপ্রতিভতা উপভোগ করে,
আলোকচিত্রী ডেকে নিয়ে এসে
পাশে দাঁড়াচ্ছে লাবণ্যে ঘেঁষে,
তবে কি এটাই দুই বন্ধুর শেষ বসন্ত?

এমন তো নয় আমরা এখনও তারুণ্যময়,
ভুরুর দুধারে কাশফুল এসে আরেক সময়
বুনে দিয়ে গেছে যাতে মিশে আছে পুণ্য ও পাপ
—একজন চুপ, অন্যের মুখে মদির প্রলাপ—
একই ঘরানার শরিক হয়েও সলতে জ্বালাতে
দুরুদুরু ভয়, নিউরোলজিস্ট গতকাল রাতে
বলে দিয়েছেন আমাদের দুই হাতেই এখন
সন্তর্পণে শুরু হয়ে গেছে পারকিনশন।

এবার প্রদীপ সূচনার পালা। আমার বন্ধু
এগিয়ে দিলেন দক্ষিণ হাত... হাতটা কাঁপছে
লক্ষ্য করেই আমি হাত রাখি হাতের উপরে
আর তক্ষুনি দেখি আমাদের দুজনের হাত
থির থির করে আকাশে উড়ছে নীল প্রজাপতি...
সইমেলা দ্যাখে, বুঝতে পারে না, এ সন্ধ্যারতি।