অমিয় চক্রবর্তী
অমিয় চক্রবর্তীর একগুচ্ছ কবিতা
প্রকাশিত : এপ্রিল ১০, ২০২২
কবি ও শিক্ষাবিদ অমিয় চক্রবর্তীর আজ জন্মদিন। ১৯০১ সালের ১০ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার শ্রীরামপুরে তার জন্ম। তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার লেখা কয়েকটি কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
রাত্রি
অতন্দ্রিলা,
ঘুমোওনি জানি
তাই চুপি চুপি গাঢ় রাত্রে শুয়ে
বলি, শোনো,
সৌরতারা-ছাওয়া এই বিছানায়
—সূক্ষ্মজাল রাত্রির মশারি—
কত দীর্ঘ দুজনার গেলো সারাদিন,
আলাদা নিশ্বাসে—এতক্ষণে ছায়া-ছায়া পাশে ছুঁই
কী আশ্চর্য দু-জনে দু-জনা—
অতন্দ্রিলা,
হঠাত্ কখন শুভ্র বিছানায় পড়ে জ্যোত্স্না,
দেখি তুমি নেই।
বৃষ্টি
কেঁদেও পাবে না তাকে বর্ষার অজস্র জলধারে।
ফাল্গুন বিকেলে বৃষ্টি নামে।
শহরের পথে দ্রুত অন্ধকার।
লুটোয় পাথরে জল, হাওয়া তমস্বিনী;
আকাশে বিদ্যুৎজ্বলা বর্শা হানে
ইন্দ্রমেঘ;
কালো দিন গলির রাস্তায়।
কেঁদেও পাবে না তাকে অজস্র বর্ষার জলধারে।
নিবিষ্ট ক্রান্তির স্বর ঝরঝর বুকে
অবারিত।
চকিত গলির প্রান্তে লাল আভা দুরন্ত সিঁদুরে
পরায় মুহূর্ত টিপ,
নিভে যায় চোখে
কম্পিত নগরশীর্ষে বাড়ির জটিল বোবা রেখা।
বিরাম স্তম্ভিত লগ্ন ভেঙে
আবার ঘনায় জল।
বলে নাম, বলে নাম, অবিশ্রাম ঘুরে-ঘুরে হাওয়া
খুঁজেও পাবে না যাকে বর্ষায় অজস্র জলধারে।
আদিম বর্ষণ জল, হাওয়া, পৃথিবীর।
মত্ত দিন, মুগ্ধ ক্ষণ, প্রথম ঝঙ্কার
অবিরহ,
সেই সৃষ্টিক্ষণ
স্রোতঃস্বনা
মৃত্তিকার সত্তা স্মৃতিহীনা
প্রশস্ত প্রাচীর নামে নিবিড় সন্ধ্যায়,
এক আর্দ্র চৈতন্যের স্তব্ধ তটে।
ভেসে মুছে ধুয়ে ঢাকা সৃষ্টির আকাশে দৃষ্টিলোক।
কী বিহ্বল মাটি গাছ, দাঁড়ানো মানুষ দরজায়
গুহার আঁধারে চিত্র, ঝড়ে উতরোল
বারে-বারে পাওয়া, হাওয়া, হারানো নিরন্ত ফিরে-ফিরে-
ঘনমেঘলীন
কেঁদেও পাবে না যাকে বর্ষায় অজস্র জলধারে।
কোথায় চলছে পৃথিবী
তোমারও নেই ঘর
আছে ঘরের দিকে যাওয়া।
সমস্ত সংসার
হাওয়া
উঠছে নীল ধূলোয় সবুজ অদ্ভূত;
দিনের অগ্নিদূত
আবার কালো চক্ষে বর্ষার নামে ধার।
কৈলাস মানস সরোবর
অচেনা কলকাতা শহর—
হাঁটি ধারে ধারে
ফিরি মাটিতে মিলিয়ে
গাছ বীজ হাড় স্বপ্ন আশ্চর্য জানা
এবং তোমার আঙ্কিক অমোঘ অবেদন
আবর্তন
নিয়ে
কোথায় চলছে পৃথিবী।
আমারও নেই ঘর
আছে ঘরের দিকে যাওয়া।
উজানী
সকাল উদয়বিষণ্ণ মেঘলা সমুদ্রে;
সিংহল ঝাপসা উঠছে নারকলবন পাহাড়মাথায়,
বোটের ডেকে চলি ডাঙার দিকে, হাতে কফি-পেয়ালা—
যাত্রীরা তাস-খেলায় মত্ত, সমুদ্র-আসমান-দ্বীপ জানে না
দুই জগতের মধ্যে আছি, তিন জগৎ, মাটির মানুষের জলের,
নীল-শাদার কেরামতি শূন্যে, সিন্ধু-শকুনের পাখায় অদৃশ্য তীর;
হঠাৎ মন ঘুরল সংকেতে, মালাবার পাহাড়ে, বোম্বাইয়ে,
সেই সমুদ্র-তোরণ অগণ্য যাওয়া-আসার;
কেন অন্যত্র আছি, আকাশ-ভরা সানাই, অত আলো
ভারতের নিঃসীম ঘর দূরে রেখে, জানি
পরিধির পরে পরিধি,আয়ুর চক্র একই যাত্রায় আবর্তিত,
পৌঁছনো কেবল এগিয়ে যাওয়া, ফিরে-আসা, বাসা-বদল,
লগ্ন দোল,
তারপর সব জাহাজ থামে শান-বাঁধা ঘাটে, স্তব্ধ,
কলম্বো-মাদ্রাজ পেরিয়ে টিকিট-মাশুলের অতীত,
কোথায়?
হে আমার দিন
তোমাকে ফিরে চাই, সমগ্র, একটিবার আমারই পৃথিবীতে
সব চেয়ে আমার ভারতী-বাংলায়, ভূমিষ্ঠ হব
থাকব মায়ের সঙ্গে, বড়ো হব, ভাই-বোন-পিতৃসংসারে,
ভাষা হবে আজ দুই বাংলার নতুন যোগে;
দেশবিদেশের আত্মীয় পাব যৌবনে শান্তিনিকেতনে,
পরিক্রমা পরে-পরে প্রেমের মহীয়ান বিরাট অজানা দেশে-দেশে,
পারাপার গাঁথব চৈতন্যের জালে, স্মৃতির চেয়ে বেশি, ঐকান্তিক,
আবার উত্তীর্ণ হব, সমাঙ্কিত, অনিঃশেষ,
সন্ধ্যায় কি পৌঁছব না শেষবার যমুনায়, গঙ্গাতীরে, কলকাতায়।
বিনিময়
তার বদলে পেলে
সমস্ত ঐ স্তব্ধ পুকুর
নীল-বাঁধানো স্বচ্ছ মুকুর
আলোয় ভরা জল
ফুলে নোয়ানো ছায়া-ডালটা
বেগনি মেঘের ওড়া পালটা
ভরলো হৃদয়তল
একলা বুকে সবই মেলে।
তার বদলে পেলে
শাদা ভাবনা কিছুই-না-এর
খোলা রাস্তা ধুলো-পায়ের
কান্না-হারা হাওয়া
চেনা কণ্ঠে ডাকলো দূরে
সব-হারানো এই দুপুরে
ফিরে কেউ-না-চাওয়া।
এও কি রেখে গেলে।
অন্নদাতা
পাথরে মোড়ানো হৃদয় নগর
জন্মে না কিছু অন্ন—
এখানে তোমরা আসবে কিসের জন্য?
বেচাকেনা আর লাভের খাতায়
এখানে জমানো রক্তপণ্য—
যারা দান দেয় তারা মুনাফায়
সাধুতার সুদ কষে তবে হয় দাতা,
নয়তো তারাও রাষ্ট্রচাকায় পিষ্ট, দরদী নাগর:
তাদের দেওয়ার ফলাবে না ধান শান-বাঁধা কলকাতা।
আসো যদি তবে শাবল হাতুড়ি
আনো ভাঙার যন্ত্র,
নতুন চাষের মন্ত্র।
গ্রামে যাও, গ্রামে যাও,
এক লাখ হয়ে মাঠে নদী ধারে
অন্ন বাঁচাও, পরে সারে সারে
চাবে না অন্ন, আনবে অন্ন ভেঙে এ-দৈত্যপুরী,
তোমরা অন্নদাতা।
জয় করো এই শান-বাঁধা কলকাতা।