অমিতাভ পালের গল্প ‘সুইসাইড নোট’
প্রকাশিত : নভেম্বর ০৫, ২০২০
পুরুষ্টু বিধবাদের প্রতি একটা প্রবল আকর্ষণ বোধ করে সে। এই আকর্ষণ দুইভাবে ডাকে তাকে— মনে আর শরীরে। মনের আকর্ষণটা তাকে শিখিয়েছে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলি আর শরীর শিখিয়েছে রসময় গুপ্ত। এই দুই শিক্ষকের হাতে পড়ে সে হয়ে উঠেছে এমন এক ভাস্কর— মনের ভিতরে একটু ভারি গড়নের মায়াময় ওই বিধবাদের মূর্তির একটা মিউজিয়ামই যেন বানিয়ে ফেলেছে। তার মনের স্টুডিওর আনাচে কানাচে পড়ে থাকে ওইসব বিধবাদের হাত-পা-স্তন-নিতম্বসহ পুরা একটা অ্যানাটমি ক্লাস। আর মনের বাইরের পৃথিবীতে তার দুই চোখ সারাক্ষণ খোঁজে ওইসব বিধবাদের কোনো একটা স্পেসিমেন, যাকে সে মিলিয়ে নেবে, ঝালিয়ে নেবে, ডুবে যাবে তার দেয়া সুখে।
যদিও এই খোঁজ সে চালাচ্ছে বহুদিন ধরে, কিন্তু পাচ্ছে না। এর ফলে সে বিদ্যাসাগর এবং বিভিন্ন সমাজ সংস্কারকদের ওপর রেগে যাচ্ছে প্রবলভাবে। বিধবাবিবাহের প্রচলন কি না হলেই হতো না? কিংবা দুই একজন পুরুষ্টু বিধবা যদি সবকিছু অগ্রাহ্য করে থেকে যেত তাদের বৈধব্যে এবং তার সঙ্গে দেখা হলেই জেগে উঠতো নতুন বোধে? হচ্ছে না, কোনোভাবেই ওইসব বিধবাদের কারো সাথে তার দেখা হচ্ছে না। তবে মাঝেমাঝে কালো, রুগ্ন, বিরক্ত কিছু বিধবাকে দেখেছে সে, কিন্তু একবার তাদের দিকে তাকানোর পরে বাসায় ফিরে নিজের কল্পনাকে সাবান দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে না নিলে সমূহ বিপদ হতো। এদিকে একান্নবর্তী পরিবারগুলিও নেই। কী যে সে করে এখন!
এভাবেই দিন যেতে যেতে একদিন সে টের পেলো, পুরুষ্টু বিধবারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে অথবা বিধবা হবার পরপরই বেছে নিয়েছে নতুন স্বামী। ফলে তার আর সুযোগ নেই। ভাবনাটা মাথায় আসতেই সে বিধবা অনুসন্ধান ছেড়ে দিল। এবার সে খুঁজতে শুরু করলো এমন কোনো নারীকে— শরীরে ও মনে যে পুরুষ্টু বিধবাদের মতো হুবহু, অথচ যার স্বামী আছে, সংসার আছে। এবার অবশ্য খুব বেশি খুঁজতে হলো না তাকে। নিজের বাসার আশপাশে তাকাতেই দেখা মিললো তেমন একজনের, যার দিকে তাকালেই মনে হয়— একেই তো আমি খুঁজছিলাম।
এখন সে প্রতিদিন দুইবেলা ওই নারীর বাসার সামনে ঘোরাঘুরি করে আর আরো বেশি লগ্ন, মোহিত হতে থাকে। নারীটিও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে খানিকটা কৌতূহলী হয়ে বারান্দায় দাঁড়ায়, আড়চোখে একটু তাকায়, সামান্য হাসির ছটায় প্রশ্রয়ও দেয় কিছুটা। আর এভাবেই তার মনের স্টুডিও ভরে ওঠে আরো আরো অঙ্গদ বৈশিষ্ট্যে, তৈরি হতে থাকে অজস্র ভাস্কর্য— যেন সে ভ্যান গগের মতো পাগল হয়ে ছুটছে কল্পনা আর বাস্তবকে মেলাতে, যেন হাতে আর সময় বেশি নেই।
এদিকে মেয়েটির প্রতি এই মনযোগ তার কানে বিভিন্ন খবর নিয়ে আসতে থাকে একটু একটু করে। এইসব খবরের মধ্যে আছে মেয়েটার নাম, তার স্বামী কি করে, বাচ্চা কয়টা— এইসব। একেবারে ডিকশনারির খটখটে শব্দগুলির মতো যেন এই খবরগুলি। বাঁশ আর খড় দিয়ে বানানো একটা কাঠামোর মতো শুধু। অবশ্য তাতে খুব একটা অসুবিধা হয় না তার, কারণ তার কাছে আছে কল্পনার মাটি আর রঙ। কাঠামোটা নিয়ে মনের স্টুডিওতে ঢুকে পড়লেই হলো। তারপরতো শরৎচন্দ্র আর রসময় গুপ্ত আছেই। সেসময় তার মনে যে ওইসব বিলুপ্ত বিধবাদের স্মৃতি জাগে না— তাও না। কিন্তু হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলেও তো হয় না। ফলে মেয়েটিকেই সে বানিয়ে নেয় নিজের পছন্দের মাপে ফিট হওয়া কোনো এক পুরুষ্টু বিধবা। তারপর ডিনার।
এরকম সময় একদিন সে খবর পেলো, মেয়েটির স্বামী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। সাথেসাথেই তার মনে জাগলো এক নতুন সম্ভাবনা— মেয়েটির স্বামী যদি হাসপাতালেই থেকে যায়, অর্থাৎ মরে যায়, তাহলেই তো মেয়েটি বিধবা হয়ে যাবে। তখন তার সারাজীবনের যে স্বপ্ন এবং অপ্রাপ্তি, যার রৌদ্রকরোজ্জ্বল দৃশ্য ও স্পর্শের সে কোনোদিনও পেলো না— এসে যাবে হাতের মুঠায়। ভাবনাটা তাকে এমনই উদ্দীপ্ত করে তুললো যে, প্রতিবেলায় সে হাসপাতালে যেতে শুরু করলো মেয়েটির স্বামীর খোঁজ নিতে। স্বাস্থ্য বুলেটিনের মতো ঘণ্টায় ঘণ্টায় নেয়া সেই খবর একবার তাকে হতাশ করে তোলে তো আবার জ্বালিয়ে দেয় আশার আলো।
কিন্তু একদিন হতাশা আসার পর আর যেতে চাইলো না, গেড়ে বসে আশাকেও ঘাড় ধাক্কা দিয়ে দূর করে দিল, কেননা সেদিনই দুপুরের একটু আগে সে জানতে পেরেছিল মেয়েটার স্বামী সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে গেছে। খবরটা পাওয়ার পর বুকটা দুমড়ে মুচড়ে একেবারে ভেঙে গিয়েছিল তার। আর সেইসাথে মনের ভিতরে থাকা মিউজিয়াম আর স্টুডিওটাও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, ভেঙে গিয়েছিল বিধবাদের সব মূর্তি। তার কাছে গেলে তখন যে কেউ দেখতে পেত তার আশপাশে সব ভাঙা বিধবারা পড়ে আছে অনাদরে আর অবহেলায়।
শেষবিকেলে সে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিল।