অমিতাভ পালের গল্প ‘মানিব্যাগ’
প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১৯
অফিস থেকে বেরিয়েই লোকটা বাসায় ফেরার জন্য বাসে উঠে পড়লো। আজ উবার বা পাঠাও- কোনোটা নেবার মতো টাকা নেই পকেটে। মাসের শেষ, ফলে একটু হিসাব করেই খরচ করতে হচ্ছে। প্রয়োজনকে দিতে হচ্ছে সবচেয়ে বড় সুযোগটা। তাই বাসে উঠে তাড়াতাড়ি বাসায় ঢুকে পড়তে পারলে শখ এবং আহ্লাদ খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না।
বাসটা খালিই ছিল, সামনের দিকের কয়েকটা সিটে বসে ছিল তিন-চারজন লোক। আর পিছনের দিকের সবটা মরুভূমির মতো জনশূন্য। মাঝামাঝি জায়গায় একটা সিট বেছে নিয়ে লোকটা বসে পড়লো জানালার ধারে। এইবার নিশ্চিন্ত, নামবার স্টপেজটা বেশ দূরে। ফলে মিনিট চল্লিশ আর কোনো নড়াচড়া নেই।
সিটটাতে গুছিয়ে বসে লোকটা পকেট থেকে বের করলো তার মোবাইল ফোন এবং একটা গেমস বের করে খেলতে শুরু করলো। ঠিক তখনই অন্যমনস্কতায় পা সরাতে গিয়ে তার মনে হলো পায়ের নিচে কিছু একটা আছে। সেটা কি জানতে মোবাইল স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে লোকটা নিচের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল, একটা মানিব্যাগ। পরক্ষণেই চোখ তুলে নিজের আশপাশে তাকিয়ে দেখলো, কেউ কোথাও নাই। মালিকহীন মানিব্যাগটাকে এবার সে ঝুঁকে তুলে নিল হাতে এবং খুলে দেখলো সেটা টাকায় ভর্তি। সাথে-সাথেই মানিব্যাগটাকে বন্ধ করে হাতের তালুর মধ্যে লুকিয়ে সে ভাবতে বসলো, এবার কি করবে।
প্রথমে তার মনে হলো, বাসের কন্ডাক্টরকে ডেকে মানিব্যাগটা বুঝিয়ে দেবে। কিন্তু কন্ডাক্টর কি মালিককে মানিব্যাগটা ফিরিয়ে দেবে? যা দিনকাল পড়েছে, এতগুলি টাকা কাউকে দিয়ে ফিরিয়ে দেবার অঙ্গীকার করানো হয়তো যাবে, কিন্তু সন্দেহের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মিলবে না সহজে। নাহ্, ও পথে যাওয়া যাবে না। তাহলে কি করা যায়? বরং তার স্টপেজ পর্যন্ত যে চল্লিশ মিনিট সময় আছে, সে পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাক। যার মানিব্যাগ হারিয়েছে, বিশেষত এতগুলি টাকা রয়েছে যেখানে, সে নিশ্চয়ই খোঁজখবর করবে। আর তাহলে মালিকের হাতেই তুলে দেয়া যাবে তার আমানত। কিন্তু মানিব্যাগ দাবি করা লোকটাই যে প্রকৃত মালিক হবে, সেটা প্রমাণ হবে কিভাবে?
প্রমাণ খুঁজতে মানিব্যাগেই অনুসন্ধান চালালো লোকটা আর টাকাগুলি গুনে ফেললো ঝটপট। এক হাজার টাকার বিশটা নোট। এবার নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। যে মানিব্যাগের মালিক হওয়ার দাবি জানাবে, সে নিশ্চয়ই জানবে এই টাকার পরিমাণ। তাই ঠিকঠাক উত্তর দিলে তার হাতেই তুলে দেবে মানিব্যাগ, ভাবলো লোকটা।
কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই একটা অন্য ভাবনা এসে ঢুকে পড়লো লোকটার মাথায়। আচ্ছা, মানিব্যাগ হারানো লোকটা যদি টের না পায় কোথায় হারিয়েছে টাকাগুলি এবং এই বাসে যদি সে আর না আসে, তাহলে কি হবে? কন্ডাক্টরকে ফেরত দেয়ার কথাতো সে আগেই বাতিল করেছে। আর কোনো বিকল্প পথ কি আছে? ভেবে দেখলো, সেরকম পথের কথা তার মাথায় আসছে না। ঠিক আছে, আপাতত নিজের পকেটে মানিব্যাগটাকে ঢুকিয়ে রেখে চল্লিশ মিনিটের অপেক্ষাটা করে ফেলা যাক। তারপর না-হয় ভাবা যাবে।
এবার লোকটা আর মোবাইলে গেমস না খেলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে লোকজন দেখতে লাগলো। হয়তো এদের মধ্যেই কেউ একজন ওই মানিব্যাগটার মালিক। হয়তো সে খোঁজাখুঁজি করছে চারদিকে তাকিয়ে কিংবা হয়তো সে এখনো জানেই না তার মানিব্যাগটা পড়ে গেছে কিংবা হয়তো ভাবছে কোনো পকেটমার তাকে সর্বস্বান্ত করে দিয়ে গেছে। ফলে অজানা সমুদ্রে দিশাহারা নৌকার মতো ঘুরতেই থাকবে সে। জানবে না এই বাসের একটা সিটের তলায় হারিয়ে যাওয়া মানিব্যাগটা এখন তার সিটেই বসা আরেকজন কোনো যাত্রীর পকেটে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।
নিশ্চিন্তেই তো। মানিব্যাগ কেবল পকেট চেনে, কার পকেট, সে ব্যাপারে তার কোনো মাথাব্যাথা নেই। এরপর টাকা হারানো লোকটা একসময় শ্রান্ত হয়ে ভাগ্যের দোষ দিয়ে ফিরে যাবে বাসায় এবং সপরিবারে কিছুক্ষণ হাহাকার করে খেয়েদেয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। পরদিন আবার সূর্য উঠবে। আবার দিন বয়ে যাবে দিনের নিয়মে। আবার সন্ধ্যা নামবে, বাসায় ফিরে যাবে সে এবং তখন দেখা যাবে, আগের দিনের দগদগে টাকা হারানোর শোক কিছুটা শুকিয়ে গেছে। আর এভাবেই দিনের পর দিন কাটবে এবং শোকটা একসময় ফুরিয়ে ফেলবে তার আয়ু। তারপর হারিয়ে যাবে মৃতদের মতো।
মানিব্যাগ কুড়িয়ে পাওয়া লোকটা এসব ভাবতে ভাবতে সিদ্ধান্ত নিল, কেউ দাবি না করলে টাকাগুলি সে নিজেই রেখে দেবে। এমনিতেই মাসের শেষ। এসময় এতগুলি টাকা হাতে পেলে দুঃশ্চিন্তা ছাড়াই বেতনের আগপর্যন্ত দিনগুলি কাটানো যাবে।
ধীরে ধীরে টাকাগুলি নিজের কাছে রেখে দেয়ার চিন্তাটা তার ভিতরে আরো জাঁকিয়ে বসলো এবং একসময় মালিকানা দাবি করলেও টাকাগুলি সে আর ফিরিয়ে দেবে না, এমনকি মানিব্যাগ পাওয়ার কথাও অস্বীকার করবে, এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেল সে। সাথে-সাথেই তার মধ্যে শুরু হলো এক অস্থিরতা। যদি মানিব্যাগ হারানো লোকটা এখন বাসে ফিরে আসে, যদি ছেড়ে যাওয়া সিটটার তলা খুঁজতে এসে তাকে পেয়ে যায়, যদি তাকে সার্চ করতে চায়…
লোকটা ভাবলো, টাকাগুলি বের করে মানিব্যাগটাকে বাইরে ফেলে দিতে। কিন্তু যাত্রী কম থাকায় বাসটাতো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ ধরে। এসময় একটা বাসের জানালা থেকে মানিব্যাগ বাইরে পড়তে দেখলেতো সবাই কৌতূহলী হয়ে উঠবে এবং ব্যাপারটা আর গোপন থাকবে না। ধুর, কেন যে বাসটা ছাড়ছে না! চলন্ত বাস থেকে মানিব্যাগটা ছুড়ে ফেলা অনেক সহজ হতো। অন্যের কৌতূহল জাগার আগেই সে চলে যেতে পারতো অনেক দূরে, অনুসন্ধিৎসার নাগালের বাইরে। সেটা যখন হচ্ছে না তখন অন্য উপায় ভাবতে হবে।
ঠিক তখনই বাসটার দরজার দিকে তাকিয়ে সে দেখলো একটা লোক উঠে আসছে। তার মনে হলো এই লোকটাই সেই লোকটা। ভয়ে তার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো। কিন্তু নতুন লোকটা একবারও তার দিকে না তাকিয়ে বসে পড়লো সামনের একটা সিটে। সেও তড়িঘড়ি করে এতক্ষণ বসা সিটটা ছেড়ে অন্য একটা সিটে গিয়ে বসলো। যাক বাবা, এখন অন্তত ঘটনাস্থলে সে নেই। তাই মানিব্যাগটাও তার পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কমে গেল।
বাসটা এবার চলতে শুরু করেছে। আপাতত আর কারো উঠে আসার সম্ভাবনা নেই। এখন কিছুটা স্বস্তি লাগছে লোকটার। কিন্তু স্বস্তির বাতাসটা বইতে শুরু করার সাথে-সাথেই একটা অস্বস্তির গন্ধ এসে ঝাপটা মারলো নাকে। আচ্ছা, মানিব্যাগ হারানো লোকটাতো পরের স্টপেজ থেকেও উঠতে পারে মানিব্যাগটাকে খুঁজতে? হয়তো সে মানিব্যাগ হারানো কথাটা পরে জেনেছে এবং সেই ফাঁকে এগিয়ে গেছে খানিকটা। হয়তো এখন সে সামনের কোনো স্টপেজে অপেক্ষা করছে ছেড়ে আসা বাসটার জন্য। এই বাসটা সেখানে গিয়ে পৌঁছালেই হয়তো সে উঠে এসে সব যাত্রীকে সার্চ করতে শুরু করবে। হয়তো সে পুলিশ নিয়েই উঠবে।
ঠিক তখনই বাসটা গিয়ে থামলো পরের স্টপেজে। লোকটা সাথেসাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো, এই বাসে সে আর থাকবে না। জনারণ্যে মিশে যেতে পারলে কে আর তাকে ধরে! যেই ভাবা সেই কাজ। তড়িঘড়ি করে সিট থেকে উঠে সেসময় বাসে উঠতে থাকা আরো কয়েকজনকে ঠেলে নিচে নেমে গেল সে। আর ঢুকে পড়লো একটা গলির মধ্যে। এবার এক প্যাকেট দামি সিগারেট কিনতে হবে এবং সুখটান দিয়ে ভেজাতে হবে এতক্ষণ ধরে উৎকণ্ঠিত গলাটা।
একটা সিগারেটের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পকেটে হাত দিয়ে লোকটা অবাক হয়ে গেল। বাস থেকে নামার সময় কে যেন মেরে দিয়েছে তার পকেটটা।