অমিতাভ পালের গল্প ‘বদল’
প্রকাশিত : নভেম্বর ০১, ২০২০
ছুটি কাটিয়ে বাসায় ঢুকবার মুখেই হোঁচট খেলো লোকটা। এটা কোনো বেতরিপদ ইটের সাথে পায়ের ধাক্কা লেগে হোঁচট খাওয়া না, বরং কোলাপসিবল গেইটের তালা খুলতে গিয়ে খুলতে না পারার বিড়ম্বনা। তালাটা অবশ্য মাঝেমাঝে খুলতে চায় না, বেগড়বাই করে, কিন্তু একটু কায়দা করে চাবির কানে মোচড় দিলে খুলে ফেলে নিজেকে। আজও সেরকমই কিছু হয়েছে ভেবে লোকটা সেই চেষ্টায় মন দিল, চাবিটাকে বিভিন্নভাবে তালার ফোঁকড়ে ঢুকিয়ে যৌনতার নতুন নতুন কায়দার মতো তালার অর্গাজম ঘটাতে চাইলো। কিন্তু কোনো চেষ্টাই কোনো কাজে এলো না। তালাটা ঠোঁট টিপে অনড় হয়ে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে আসা লোকটার ক্লান্ত শরীরটাকে বিদ্রুপ করতে থাকলো সমানে।
’তাহলে কি বাড়িওয়ালা তালাটা বদলে ফেলেছে?’ ব্যর্থ ও বিরক্ত লোকটা এরকমই কিছু একটা ভেবে তালাটাকে আরেকবার ভালো করে দেখলো। কিন্তু তালাটাতো বদলানো হয়নি, ছুটির আগের স্মৃতি ঘেঁটে এটুকু ঠিকই বুঝতে পারলো সে। তালাটা আগেরই, অথচ তার চাবিতে খুলছে না, এরকম অদ্ভুত সমস্যায় পড়ে লোকটার ক্লান্তি যেন বেড়ে গেল আরো। তার ইচ্ছা করলো রাস্তাতেই বসে পড়ে। তবে সেই মূহূর্তেই একজন লোক এসে তালাটা খুলে ভিতরে যাওয়ায় তারও ভিতরে যাবার সুযোগ তৈরি হলো।
তড়িঘড়ি ভিতরে ঢুকে পড়লো সে এবং ঢুকে সিঁড়িটা হারিয়ে যাবে, এই ভয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লো দোতলায়। এই তলাতেই তার বাসা। ওই তো দেখা যাচ্ছে দরজাটা, হেজবোল্টে নিজেকে সুরক্ষিত করে একটা তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে ‘ডু নট ডিস্টার্ব’ সাইনবোর্ডের মতো। তবে সে বিরক্ত করলে দরজাটা কিছু মনে করবে না, বরং প্রায় সপ্তাহখানেক পরে তাকে দেখে খুশিই হবে, মনে হলো তার। আর সেই মনে হওয়ার সার পেয়ে গজগজিয়ে বেড়ে ওঠা গাছের মতো আত্মবিশ্বাসে সে এগিয়ে গেল দরজাটার দিকে এবং পকেট থেকে তালার প্রেমিক চাবিটাকে বের করে আনলো। কিন্তু তালা খুলতে গিয়ে এবারও সে ব্যর্থ হলো। ‘কিন্তু এটাতো অসম্ভব’- ভাবলো লোকটা। এই তালা সবসময়ই অন্যকোনো প্রেমিককে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। সতীসাধ্বীর মতো জীবনযাপন করেছে। কিন্তু এবার কি হলো তার? ছুটির এই সময়টাতে সে কি স্বৈরিণী হয়ে গেছে? গোপনে করে ফেলেছে কোন পরকীয়া প্রেম? সে তালাটার আচরণের কিছুই বুঝতে পারছিল না। এদিকে শরীরের ক্লান্তি এখন তাকে কোনো নিশ্চিন্তে পৌঁছে দিয়ে অবসর নিতে চাইছে।
সে আরো কয়েকবার চেষ্টা করলো তালাটাকে খুলতে। কিন্তু ব্যর্থতা ছাড়া আর কোন শব্দার্থ, সিনোনিম দেখাতে পারলো না তালাটার অভিধান। ’এখন আমি কি করবো’— এই ছিল লোকটার পরবর্তী চিন্তা।
দুই.
লোকটা এখন আবার কোলাপসিবল গেইট দিয়ে বেরিয়ে বাসাটার চারপাশে ঘুরছে। দেখতে চাইছে— যে বাসাটায় সে এসেছে, সেটাতেই সে আসতে চেয়েছিল কিনা। এক ভয়ংকর দর্শনঘটিত সমস্যায় আক্রান্ত হবার আগে তাই সে দোতলায় তার ফ্ল্যাটটার জানালার দিকে সমস্ত মনযোগ, আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি জিনিসগুলিকে সূচিমুখ করে দাঁড়িয়ে দেখছিল— তার ফ্ল্যাটটা অন্ধকার কিনা, কারণ সে তার বউ আর ছেলেকে রেখে এসেছে তার মায়ের কাছে। ফলে ফ্ল্যাটের জানালাটা অন্ধকারই থাকবে।
তার সূচিমুখ মনযোগ যেইমাত্র তার ফ্ল্যাটের জানালায় পৌঁছালো— অমনি দেখা গেল জানালায় আলো জ্বলছে। এখন যে বিস্ময় লোকটার মধ্যে এলো, যে অবিশ্বাসকে সে জন্মাতে দেখলো তার জানালার আলোতে— একটা নতুন বিজ্ঞানের দরকার তাকে ধরবার জন্য— এক গোপন যুক্তিবাদী মন লোকটাকে এই কথা বললো। কিন্তু বিজ্ঞান কি আর ব্যক্তিগত জীবনের আবেগকে পাত্তা দেয়? লোকটার শরীর রি রি করে উঠলো ওই জানালার আলোটা দেখে। ঠিক সেই মূহূর্তেই ওই আলোকে তছনছ করে দিয়ে বাম থেকে ডানে চলে গেল একটা ছায়া। তার মাথায় চূড়া করে বাঁধা চুল, তার স্তন দীপ্ত যৌবনের তীব্রতায় অহংকারী, অথচ সে জানালার বাইরের জগত এবং সেই জগতের অন্ধকারকে উপেক্ষা করে, ঘরটাকেই পৃথিবী ভেবে হেঁটে যাওয়ার সাহসে— সূচিমুখ মগ্নতাকে পাত্তাই দিলো না।
এদিকে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকা লোকটা তখন ভাবছে, তার ফ্ল্যাটে কারা এলো, কারাই বা তার রেখে যাওয়া অন্ধকারকে আলোয় বদলে দিল।
তিন.
লোকটা যখন রাস্তায়, যখন তার জানালার আলো তাকে অপরিচিত করে ফেলেছে— ঠিক তখনি বাড়িটার বাড়িওয়ালার সাথে তার দেখা হলো। এই লোকটাকেই কয়েক বছর ধরে প্রতি মাসে ভাড়ার টাকাটা নিজের হাতে দিয়ে আসে সে। এই লোকটা নিশ্চয়ই তালাগুলির মতো আচরণ করবে না, এই ভেবে লোকটা তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
’বলেন, কি বলবেন’— বলে তার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল বাড়িওয়ালা। সে তখন শুরু করলো তার এতক্ষণের সব বিদ্বেষ, রাগ থেকে তৈরি হওয়া উষ্মার ঝাঁঝ উগড়াতে এবং জানিয়ে দিল— এভাবে চললে আগামী মাসেই সে বাড়ি ছেড়ে দেবে।
’কিন্তু আপনি কে বলেন তো?’— বাড়িওয়ালার এই প্রশ্নে আর কিছুই বলতে পারলো না লোকটা। হয়তো বলতে পারতো, কিন্তু প্রশ্নটার অভিঘাত তাকে নিজের কাছেই এমন অচেনা করে দিল যে নিজেকেই চিনতে পারলো না সে। শুধু কোনমতে বলতে পারলো— আমি আপনার বাসায় ভাড়া থাকতাম।
’কিন্তু আপনাকে তো চিনতে পারছি না’— বাড়িওয়ালার এই কথায় একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল সে। তার প্রতিমাসের ভাড়া, বাড়িওয়ালার সাথে তার হাস্যোজ্জ্বল কথোপকথন— কিছুকেই সে দাঁড় করাতে পারলো না নিজের সাক্ষী হিসাবে।
চার.
লোকটা এখন রাস্তায় হাঁটছে। একটা হোটেলের রুম খুঁজছে সে।