অমিতাভ পালের গল্প ‘গৃহবধু’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২০

আমাকে গৃহবধুই বলা যায়। ঘণ্টা দুয়েকের একটা ছোট চাকরি করা ছাড়া বাকি সময়টা আমি বাসাতেই থাকি, বাসার সব কাজকর্ম করি। ফলে গৃহবধু না হলেও প্রায় গৃহবধুতো আমি অবশ্যই।

আমার স্বামী অবশ্য চাকরি করে। সকাল নয়টার দিকে বেরিয়ে যায় আর সন্ধ্যা ছয়টার পরে বাসায় ফেরে। ফলে রাতের খাবারটাই কেবল আমরা একসাথে খেতে পারি। অবশ্য এটা নিয়ে আমার কোনো দুঃখ নাই। কেননা সংসার চালাতে গেলে এই পরিশ্রমটুকু ওকে করতেই হবে। কিছু পাওয়ার জন্য কিছু ছাড়তো দিতেই হয়।

অফিস ছাড়া বাকি সময়টাতে অবশ্য আমার স্বামী বেশ ঘরকুনো। টেলিভিশন, কম্পিউটার, পত্রিকা— এসব নিয়ে ও কাটিয়ে দেয় ওর সন্ধ্যা আর ছুটির দিনগুলি। বন্ধুবান্ধব, আড্ডা, মদ খাওয়া— যা সব করে এখনকার স্বামীরা— তার কিছুই ও করে না। তাই বলে যে আমার সঙ্গে খুব আড্ডা দেয়, গল্পগুজব করে— এমনটাও না। তবে আমি একটু গল্পবাজ বলে ওর সঙ্গে একাএকাই কথা বলে যাই আর ও হু হা করে সেসবের উত্তর দেয়। এতে আমি কিছু মনে করি না। কারণ ও এইরকমই। সবাইতো আর একরকম হয় না। আর একরকম হলে নিঃসন্দেহে আমাদের মধ্যে ঘনঘন ঝগড়া লেগে যেত। সংসার আসলে বিপরীতধর্মী যুগলদেরই তৈরি করা উচিত।

মোদ্দা কথা, আমার স্বামীকে আমি ভালোই চিনি আর পছন্দও করি। তো আমার এই স্বামী ভদ্রলোকটি হঠাৎ একদিন যথাসময়ে অফিস থেকে ফিরলো না। প্রথমে আমি খুব একটা চিন্তিত হইনি। কারণ একদিন দেরি হলে এমনকিছু মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা যখন রাত আটটা পার হয়ে গেল এবং ও কিছু জানালোও না, তখন কপালটা একটু কুঁচকালো আমার। এত দেরিতো ও করে না। ভাবনাটা আমাকে ফোনের কাছে নিয়ে গেল এবং আমি বাধ্য হলাম ওকে ফোন করতে। রিং বাজছে, বাজছে… কিন্তু ফোনটা কেউ ধরছে না। এইভাবে দ্বিতীয় আর তৃতীয় রিংয়েও ফোনটা যখন কেউ ধরলো না, তখন সত্যিই দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম মন প্রথমেই কুডাক ডাকে বলে। তারপর ভাবলাম, অফিসে হয়তো জরুরি মিটিং চলছে, তাই ফোন ধরতে পারছে না। নিশ্চয়ই মিটিং শেষ হলে আমাকে ফোন করবে। ভাবলাম, ফেইসবুক সার্ফ করে অপেক্ষার সময়টা কাটিয়ে দেই।

হঠাৎ চমক ভাঙতেই দেখলাম রাত সাড়ে নয়টা বাজে এবং আমার ফোন এখনো বাজেনি। এবার মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমাদের প্রায় এক বছরের দাম্পত্য জীবনে এরকমটাতো কখনো হয়নি। তাহলে কি ওর কোনো বিপদ হলো? এবার আমি ফোন করলাম ওর ফোনে। ফোনটা বাজতে বাজতে রিংটোন যখন প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছে, এইরকম সময়ে ফোনটা ধরলো কেউ। গলাটা ঠিক ওর মতো না, আবার মেলেও খানিকটা, তবে স্বভাবটা যেন অন্যরকম— বেশ হৈচৈ আর উৎফুল্ল। ও একটু গম্ভীর ধরনের, কাটকাট শব্দে কথা বলে, কিন্তু এই গলাটা যেন আমার মতোই ছটফটে, একসঙ্গে অনেক কথা বলে ফেলে অন্যকে বলার সুযোগ না দিয়ে। ‘ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমি ফিরছি, তোমার ক্ষুধা লাগলে খেয়ে নাও, দুঃশ্চিন্তা করো না, আমি ঠিক আছি’— একটানা এই কথাগুলি বলে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা কেটে দিল ও।

এই কথোপকথনটা, অথবা শুধু কথনটা আমার দুশ্চিন্তা আরো বাড়িয়ে দিল। বারবার মনে হতে লাগলো, এই লোকটা আমার স্বামী না, অন্য কেউ। কিন্তু তাইবা কি করে হবে? অথচ ওই হৈচৈ, উৎফুল্ল, ছটফটে গলার আওয়াজ— ওটাইবা তাহলে কার? আচ্ছা, এমন কি হতে পারে না— আমার স্বামীকে কেউ ধরে নিয়ে গেছে, তার কাছে টাকাপয়সা চাইছে, তাকে ভয় দেখাচ্ছে আর আমি ফোন করলে আমার স্বামীর ভূমিকায় অভিনয় করছে— তাই গলার আওয়াজের এমন আচরণ বদল? নাকি আমার স্বামীই বদলে গেল? আজকাল মানুষ যেভাবে দ্রুত বদলে যাচ্ছে— ওর বদলাতে কতক্ষণ? চারপাশে মেজাজ খারাপ করা, দুশ্চরিত্র, মিথ্যাবাদী মানুষের যে ভিড় আজকাল দেখি— তাতে এই ভয়টা আমার মধ্যে গেড়ে বসছিল যে, ও’ও বোধহয় কখনো এরকম হয়ে যাবে। কিংবা আমিও বদলে যাব হয়তো…। তবে আমি এখনো বদলাইনি কিন্তু ও বোধহয় বদলে গেছে।

রাত সাড়ে দশটার দিকে যখন বাসায় ফিরলো— আমি খুব মনযোগ দিয়ে ওকে খেয়াল করতে শুরু করলাম। কিভাবে জামাকাপড় বদলায়, কিভাবে হাতমুখ ধোয়— সব। কিন্তু খেয়াল করলাম ও প্রচুর কথা বলছে, হাসছে এবং আমার সাথে খুনসুঁটি করছে— যা ও কখনোই করে না। এসব বরং আমার করার কথা অথচ আমি গম্ভীর হয়ে ওকে দেখে যাচ্ছি আর মনে মনে ওর বদল সম্পর্কে নিশ্চিত হচ্ছি। ডাইনিং টেবিলে ভাত খেতে বসার পর দেখলাম ও অন্যদিন যেভাবে খায়— আজ সেভাবে খাচ্ছে না। একটা যেন তাড়াহুড়া ওকে ধাওয়া করছে পিছন থেকে। গোগ্রাসে সব ভাত খেয়ে ও উঠে পড়লো টেবিল থেকে এবং হাতমুখ ধুয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়।

ওর বদলে যাওয়ার ব্যাপারটাতে আমি এখনো ঠিক নিঃসন্দেহ না। চিন্তা করতে লাগলাম কিভাবে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়। ঠিক করলাম শোবার পরে আরেকটা শেষ পরীক্ষা করবো আমি। ওর পাশে শোয়ার পরই ও শুরু করলো আমার শরীর নিয়ে খেলতে। আর তখনই আমি বুঝে ফেললাম, এই একটা জায়গায় ও একটুও বদলায়নি। ওর সবগুলি অভ্যাস নিয়ে আমার শরীরে ও ঘুরে বেড়াচ্ছে অবিকল ওর মতো করে। মনটা আমার সাথেসাথে হালকা হয়ে গেল। একটু পরে, যখন সব শেষ— ওর কাছে জানতে চাইলাম দেরির কারণ। ’আজ ইউনিভার্সিটির এক বন্ধুর সাথে অনেকদিন পরে দেখা হয়েছিল। দুজনে একটু গাঁজা খেয়েছিলাম’ বললো ও।