অপূর্ব চৌধুরীর প্রবন্ধ ‘প্রকৃতি প্রাণীদের ডাক্তারখানা’

প্রকাশিত : আগস্ট ১৭, ২০২০

পার্কে হাঁটছেন। সঙ্গে কেউ নেই। একা। একটু পরে দেখলেন কেউ একজন পাশ কেটে গেল। সাথে একটা কুকুর পেছনে পেছনে। কুকুরটি কেমন যেন জোর করে হাঁটছে। হঠাৎ দেখলেন মালিকের পিছ ছেড়ে কুকুরটি ঘাসের মাঠে কি যেন শুঁকছে। একটু পর অবাক হবার পালা। কুকুরটা হঠাৎ করে ঘাস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। সারাজীবন দেখে এলেন গরু-ছাগল ঘাস খায়, কিন্তু কুকুরও যে ঘাস খায় মাঝে মাঝে, এই প্রথম দেখলেন। কিন্তু এত কিছু থাকতে মাঝ মাঝে কুকুর কেন ঘাস খায়?

শরীর বেঠিক হয়ে গেলে তাকে ঠিক করতে ওষুধের দরকার। আধুনিক বিশ্বে বেশিরভাগ মানুষ যে ওষুধ খায়, তা কৃত্রিমভাবে ল্যাবে তৈরি করা হয়। কৃত্রিম ওষুদের ব্যবহার দুশো বছরের মাত্র। তার আগে প্রকৃতিই ছিল ওষুধের উৎস। প্রকৃতি ছিল সকল প্রাণীদের ফার্মেসি। ল্যাবে প্রস্তুত কৃত্রিম ওষুধের একই রাসায়নিক উপাদান প্রকৃতির বিভিন্ন উৎসে পাওয়া যায়। কিন্তু মানুষ কি করে জানলো অমুক পাতায়, অমুক বাকলে কিংবা গাছের শেকড়ে কিংবা অমুক ফলের রসে শরীর ভালো হয়?

বিবর্তনে মানুষ ওষুধের ব্যবহার প্রথম শেখে প্রাণীদের কাছ থেকে! শুনতে আশ্চর্য লাগছে, তাই না! তারমানে প্রাণীরাও মানুষের মতো ওষুধ ব্যবহার করে। এই নিয়েই আজকের গল্প। শুরুতে কুকুরের ঘাস খাওয়ার কথা বলেছিলাম। কুকুরের পেটে যখন কোনো সমস্যা হয়, বদহজম হয়, কৃমি থাকে, কুকুররা তখন কিছু ঘাস খায়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হড়হড় করে পায়খানা করে পেট খালি করে ফেলে দ্রুত। কখনো হড়হড় করে বমিও করে দেয়। তাতে পেট থেকে জীবাণুগুলো বেরিয়ে আসে দ্রুত। তারমানে, ঘাস হলো কুকুরের হজমি বড়ি!

দেখা গেছে শুধু কুকুর নয়, বিভিন্ন ধরনের পাখি, মাছি, লিজার্ড, হাতি, বানরা শরীর খারাপ হলে প্রকৃতির বিভিন্ন কিছুকে ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করে। প্রাণীরা এটি কিভাবে জানে, সে গল্প বিজ্ঞানের আরেকটি গল্প। সে গল্প অন্যদিন বলবো। তবে মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীরা ওষুধ হিসাবে কি খায় তার গল্প বলা যায়। প্রাণীদের এই বিভিন্ন ধরনের self medication নিয়েও বিজ্ঞানের একটি শাখা আছে। নাম Zoopharmacognosy.

একটি বানর যখন কলা ছিলে খায়, কলার গায়ে লেগে থাকা আঁশের মতো চামড়ার কিছু সাদা অংশও টেনে উঠিয়ে খায়। যেমনটা আমরা মানুষরাও করি। মাতা বানর থেকে শিশু বানরও সেটা শিখে একই প্রক্রিয়ায় খায়। যেমনটা মানবশিশু মা-বাবাকে যেভাবে খেতে দেখে, সেভাবে খায়। বিবর্তনের এমন ধারাগুলো টিকে থাকে পরম্পরায় এই জন্যে যে, কাজগুলো ভালোভাবে বেঁচে থাকতে সহায়ক। নতুন কোনো অভ্যাস কিংবা ব্যবহার কিংবা কোনো একটি খাদ্যের ব্যবহার বেনেফিটেড হলে প্রাণীরাও একই কাজটি বারবার করতে থাকে অভিজ্ঞতটার আলোকে ।

যেমন শিম্পাঞ্জি যখন পেটে কৃমির উপদ্রব অনুভব করে, তখন তারা Aspilia নামের সূর্যমুখী ধরনের ফুলের পাতা খায়। Aspilia বুনো ফুলটি বেশি হয় আফ্রিকার জঙ্গলে। মজার ব্যাপার হলো, শিম্পাঞ্জিরা এই ফুলের পাতা সহজে খায় না। আবার যখন খায়, তখন একটা বিশেষ পদ্ধতিতে খায়। শিম্পাঞ্জিরা যখন কোনো গাছের পাতা খায়, তা তারা ছিঁড়ে ছিঁড়ে মুখে ঢুকিয়ে চিবায়। কিন্তু কিছু মুহূর্তে শিম্পাঞ্জিরা Aspilia গাছের কাছে গিয়ে কিছু পাতা নাক দিয়ে প্রথমে শুঁকে, তারপর সব পাতা নয়, দুটো বিশেষ ধরনের পাতা একসাথে হাতে নিয়ে রোল করে গিলে ফেলে।

কী অদ্ভুদ ব্যাপার! কিংবদন্তি প্রাইমেটোলজিস্ট Jane Goodall তাঞ্জানিয়াতে শিম্পাঞ্জির উপর কাজ করতে গিয়ে এটি প্রথম লক্ষ্য করেন। পরে তিনি পরীক্ষা করে দেখতে পান, ওই পাতায় thiarubrine-A নামের একধরনের রাসায়নিক উপাদান আছে, যা কৃমিনাশক। আবার সাথে ঐসব শিম্পাঞ্জির বিষ্ঠা পরীক্ষা করে তাতে কৃমি এবং জীবাণুর সন্ধান পান। সাথে তিনি দেখতে পান, লোকাল Tongwe গোত্রের লোকেরা এই পাতার চা খায় পেটে কৃমির উপদ্রব হলে। এবং সত্যি সত্যি তা কাজ দেয়! তাহলে শিম্পাঞ্জি মানুষ থেকে শিখেছে কাজটি, নাকি মানুষ শিম্পাঞ্জিদের দেখে কাজটি শিখেছিল!

ভালুক ও হরিণরাও জীবাণু আক্রান্ত হলে বিশেষ ধরনের পাতা খায়। তাতে তাদের শরীর দ্রুত সেরে ওঠে, আবার নরমাল জীবন শুরু করে। প্রকৃতি প্রাণীদের ডাক্তারখানা। বিভিন্ন ধরনের প্লান্টস উৎসগুলো প্রাণীদের মেডিসিন। লিজার্ডকে কোনো বিষাক্ত সাপে কামড়ালে দেখা গেছে সাপের বিষ থেকে রক্ষা পেতে এক বিশেষ ধরনের গাছের শেকড় খায় তারা। সাপুড়েদের কাছে কিছু শেকড়ের সন্ধান আছে। এই শেকড়ের কথা জানতে পেরেছে তারা প্রাণীদের কাছ থেকেই।

Monarch Butterfly এর বাংলাকরণ করলে দাঁড়ায়, রাজা প্রজাপতি। মাঝে মাঝে এই ধরনের প্রজাপতিগুলো মারাত্মক কিছু প্যারাসাইটে আক্রান্ত হয়। দেখা গেছে, শুধুমাত্র এমন আক্রান্ত হলে প্রজাপতিগুলো Milkweed জাতের কিছু গাছে পাতায় লার্ভার জন্ম দেয়। প্রজাপতিদের লার্ভাকে বলে caterpillars। মানে বাচ্চা প্রজাপতি। অন্য সময়ে অন্য গাছের পাতার উপর caterpillars দের জন্ম হলেও কেন মাঝে মাঝে Milkweed গাছের পাতার উপর বংশ বিস্তার করে? বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, Milkweed গাছের পাতায় cardenolides নামের একটি বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান থাকে। cardenolides একধরনের Cardiac glycoside স্টেরয়েড। মানুষের জন্যে যেমন বিষাক্ত, তেমনি এটি প্রজাপতিকে আক্রান্ত করা প্যারাসাইটকেও মেরে ফেলে। প্রজাপতিরা যখন বুঝতে পারে এমন প্যারাসাইট আক্রান্ত, তখন খুঁজে খুঁজে এই বিশেষ ধরনের গাছের পাতায় গিয়ে লার্ভা ছাড়ে। বাচ্চাগুলো ইনফেকশন থেকে বেঁচে যায়। শুনতে কী অদ্ভুত লাগে, তাই না! পাতাগুলো যেন প্রজাপতিদের হাসপাতাল।

ইথিওপিয়ায় একধরনের বেবুনদের লক্ষ্য করে দেখা গেছে, পেটে Flatworm জাতীয় কৃমি হলে একধরনের পাতা খায়। পাতার ভেতর থাকা রাসায়নিক পদার্থটি কৃমিনাশক ওষুধ হিসাবে কাজ করে। পাখিরা যখন কোনো ধরনের ব্যাকটেরিয়া কিংবা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, শরীরে পিঁপড়া ডলে, পিঁপড়ার বাসা ভেঙে পিঁপড়া না খেয়ে পালকে শরীরে পিঁপড়াকে উঠতে দেয়। তখন পিঁপড়া কামড় দিলে একধরনের রাসায়নিক পদার্থ বের হয়। Formic acid। ল্যাটিন Formica মানে Ant. এখন খাবারের Preservative হিসাবে ফরমিক এসিড ব্যবহার করা হয়। এটার আরেকটি গুণ হলো আন্টি ব্যাকটেরিয়াল। পিঁপড়া কামড়ালে পাখিদের শরীরে এই ফরমিক এসিড জীবাণুদের মেরে ফেলে। তারমানে পিঁপড়া হলো পাখির মলম। প্রায় দুশো প্রজাতির পাখিরা এমন করে।

Red Macaws প্রাণীদের পেটে ব্যাকটেরিয়া কিংবা কোনো প্যারাসাইটের উপদ্রব শুরু হলে তারা একধরনের বিশেষ মাটি খায়। কিন্তু অন্য সময় এই মাটি কখনো খায় না তারা। মাটিতে থাকা রাসায়নিক উপাদানটি এন্টিবায়োটিকসের কাজ করে। আফ্রিকার কিছু হাতি প্রেগনেন্ট সময়ে কিছু কাছের পাতা খোঁজে। বিশেষ করে Starflower নামের একধরনের গাছের পাতা। যখন লেবার পেইন ওঠে, তখন এই গাছের পাতা খায়। তাতে ইউটেরাসের সংকোচন ক্ষমতা বেড়ে গিয়ে প্রসব সহজ করে। তাহলে বলা যায়, Starflower হলো হাতিদের ধাত্রীমা।

মাদাগাস্কারে কিছু লেমুর আছে, প্রেগনেন্সির সময় জীবাণু আক্রান্ত হলে কিংবা শরীরকে ভালো রাখতে, কখনো মাতৃদুগ্ধ তাড়াতাড়ি সিক্রেট শুরু হতে ডুমুর এবং তেঁতুল গাছের পাতা খায়। ইন্দোনেশিয়ায় একধরনের ওরাংওটাং আছে, যারা Dracaena cantleyi গাছের পাতায় থুতু লাগিয়ে তা শরীরের হাতে পায়ে ঘষে। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখতে পেল, ওই গাছের পাতায় একধরনের কেমিক্যেল থাকে যার আন্টি ইনফ্লামেটরি ইফেক্ট আছে। ওরাংওটাং শরীরে কোনো ব্যথা অনুভব করলে এমন পাতা ঘষে শরীরে। স্থানীয় আদিবাসীরাও এমন পাতা খায় শরীরে বা হাড়ের কোনো ব্যথানাশক ওষুধ হিসাবে। বলা যায় Dracaena হলো ওরাংওটাংদের প্যারাসিটামল।

প্রাণীদের এমন কিছু খাওয়া আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া কিংবা আমাজন অঞ্চলের আদিবাসীরা হাজার হাজার বছর ধরে জানতো। কারণ তারা প্রাণীদের কাছ থেকেই শিখেছে প্রাণীদের লক্ষ্য করে। কিন্তু আধুনিক মানুষরা এসব গভীরভাবে জানতে শুরু করে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে মাত্র। আদিবাসীরা যা হাজার হাজার বছর আগেই জানতো, আধুনিক মানুষ তা জানতে পারলো ষাট বছর আগে মাত্র!