অনন্য সাঈদের গল্প ‘রুমুর লম্বা বিনুনি’
প্রকাশিত : আগস্ট ১৬, ২০২১
এক.
ট্রান্স জেন্ডারের সাথে শোয়ার অভ্যাস নেই রুমুর। ভাবতেও শরীরটা গুলিয়ে যাচ্ছে। ঘন ঘন পায়চারির ফলে ঘামে চুপসে যাচ্ছে শরীর। মনে হচ্ছে, এখনি নেতিয়ে পড়বে সে। আয়নার সামনে মুখ করে একবার নিজেকে দেখে নিল। নাহ, চেহারার খানিকটা এখনো বাকি আছে বৈকি!
এই আয়নাটা আরিফের কিনে দেয়া। আরিফ! আহ, নামটা মনে এলেই শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। কী হতো যদি রুমুর সাথে তার পরিচয়ই না হতো? কী ড্যাশিং চেহারা ছিল আরিফের। একবার তাকালে মনে হয় বুকের গভীরটা পর্যন্ত দেখে ফেলছে। গভীর মানে গভীর— চামড়া, নিপলস, ব্রেস্ট ভেদ করে কলিজার গোড়া পর্যন্ত সে দেখছে।
রটনা ছিল আরিফ দেখতে যত হ্যান্ডসামই হোক বিছানায় তেমন যায় না! এসব মানুষের ফালতু কথা, রুমু বিশ্বাস করেনি। ওরা কি আরিফের সাথে সংসার করেছে? সংসার হলো রুমুর। দুই বছর ১৮ দিনের সংসার। সংসার বলাটা ঠিক হবে? তো কি বলবে সে? বাংলা অভিধানে সংসারের চেয়ে ভালো শব্দ জমা নেই।
রুমুর বাসর হয় খালিয়াজুড়ির এক গ্রামে। আষাঢ়ের প্রথম সপ্তাহ। এখানে কদম ফুলের অপেক্ষায় বর্ষার আমেজ আসতে বিলম্ব করে না। এখানে বর্ষা মানে জল আর জল। অথৈ জলের কিয়ামত। শিশুরা জলে নেমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুবসাঁতার কাটে, বৃদ্ধরা তাদের ডাকতে ডাকতে মন্থন করে নিজেদের শৈশব আর জোয়ানরা মাছ ধরে খালুই নিয়ে যখন বাড়ি ফিরে তখন স্ত্রীরাও জানে, তাদের বঠিগুলো খুব ব্যস্ত থাকবে অন্তত চারমাস। এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতেও যেতে হয় নৌকা দিয়ে। শহুরে মেয়েরা হয়তো উপন্যাসের ভাষায় বলবে, হাউ এক্সাইটিং! রুমুর এসব জায়গা অনেক আগেই দেখা। মামা বাড়িতে এসেই তো আরিফের সাথে তার পরিচয়।
একদিন খুব ভোরে ইদুকে নিয়ে সে ঘুরতে বেড়িয়েছে। একটা ছোট নৌকাতে দু`জন ঘুরে ঘুরে দেখছে হাওরের অস্থায়ী মাছের বাজার। কে জানতো মাছ দেখতে এসে নিজেই সে ধরা পড়বে আরিফের জালে! বাড়ি ফেরার সময় রুমুর মনটা কেমন যেন আচমকা বেখেয়ালি হয়ে গেল। হাওরের ঢেউয়ের মত তা কেবল দুলতে দুলতে গান গাইতে চাইলো। ছোট বেলায় সে উদীচীতে গান শিখেছে। কিন্তু এই সকালে তার রবীন্দ্র সংগীত গাইতে মন চাচ্ছে না। রুমু নৌকার একপাশে বসে পা দুটো ভিজিয়ে দিল জলে। ইদু যতই বলুক, আপা, পইড়া যাবেন কিন্তু, পইড়া যাবেন কিন্তু। রুমুর সেদিকে মন নেই। রুমু গাইতে থাকে, হাত খালি, গলা খালি কন্যার নাকে নাকফুল। তার মন চায় হাওড়ের জলে চুল খুলে সাঁতার দিতে। সে কি খুব বড় হয়ে গেছে? অন্তত এই বিশাল হাওড়ে সাঁতার না দেয়ার মতো বড়!
হঠাৎ পানিতে কিছু একটা পড়ে যাওয়ার শব্দ হয়। ইদু আনমনে ভাবে, রুমু আপা! নাহ, রুমু গান থামিয়ে পেছনে তাকায়, একটা কেউ যেন ইচ্ছে করেই জলে ঝাপ দিল। খালি নৌকাটা পাতার মতো থির থির করে কাঁপতে কাঁপতে ঘুরতে লাগলো। ছেলেটাকে তো আর দেখা যাচ্ছে না। মিনিট খানেক পর রুমু হঠাৎ টের পেল তার পায়ে কিছু একটা চিমটি কাটছে। মুহূর্তেই ভয়ে পা দুটো নৌকায় টেনে নিল কিছু পরেই ছেলেটাও অনেকটা দূরে ভেসে উঠে আবার ডুব দিয়ে নিজের নৌকায় গিয়ে উঠলো। রুমু বুঝে উঠতে পারলো না কিসে তার পায়ে চিমটি কাটলো। না, সাপ নয়, কোনো দাগ তো নেই, তবে পা চুলকাচ্ছে কেন!
আরে আরিফ বাই!
ইদু বিকেলে বাজারে আসিস, বিরাট আলাপ আছে!
ইদু সন্ধ্যায় বিরাট আলাপ সেড়ে বাড়ি ফেরে। কিছু আলাপ সে জমা রাখে রুমুর বালিশের নিচে। ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে সেই চিঠি গিয়ে পড়ে রুমুর মামির হাতে। সকাল হতেই বাড়ির ঘাটে এসে নৌকা ভিড়ে আর রুমু ফিরে আসে শহরে। বাংলা মুভির নায়কদের মতো আরিফও সপ্তাহে একদিন শহরে এসে দেখা করে রুমুর সাথে। তারপর ঘটনা খুব সিম্পল। রুমু-আরিফ পালিয়ে বিয়ে করে । তিনমাস সংসার করার পরেই শুরু হয় ঝগড়া। রুমুর বাড়ি থেকে টাকা আনার জন্য চাপ দিতে থাকে আরিফ। রুমুও ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, অতিরিক্ত মাদক সেবনে আরিফের পৌরুষত্বহীনতার কথা।
তখন জুলাই মাস। অসহ্য গরম। রুমু একদিন আবিষ্কার করে পাকা আমের মতো ফুলে উঠছে তার মুখ। ডেট মিস হয়েছে দুইবার। ভয় আর বিহব্বলতা তাকে ঘিরে ধরে। সদ্য বাসা পালটানো পাশের বাড়ির ভাবি এসে জানতে চায়, এই মাইয়া এত পায়চারি করতেছ ক্যা?
দুই.
ফার্স্ট ইয়ারটা শুরু হলো দারুণ এক্সাইটমেন্ট নিয়ে। কাফি স্যার ক্লাশে এসেই বললেন, একটা গল্প বলি, সন্ধ্যার গল্প।
কাফি স্যার গল্প শুরু করলেন ।
রুমুর মনে হচ্ছে সে চোখ বন্ধ করে আছে। ফ্রগ পড়া একটা মেয়ে একবার এ ঘর একবার ও ঘর দৌড়াচ্ছে। তার পিছন পিছন দৌড়াচ্ছে হাফপেন্ট পড়া হাসিব। মেয়েটা দৌড়াচ্ছে আর বলছে, না না, দিব না, দিব না। একসময় কারেন্ট চলে যায় আর সে খাটের নিচে লুকানোর সুযোগটা হাতছাড়া করে না। কিন্তু ও পাশ থেকে চোখের মত চকচকে কিছু একটা জ্বলতে থাকে। বিড়াল! নাহ, রুমুদের বাসায় কোন বিড়াল নেই তো! রুমু আম্মা আম্মা করে কাঁদতে কাঁদতে খাটের নিচ থেকে বেড়িয়ে আসে।
ফাস্ট মিডে তেমন ভালো রিজাল্ট হলো না । হবার কথাও না। ব্যাচের সবাই প্রায় দৌড়াচ্ছে সিনিয়রদের পিছনে। যার দখলে যত নোটস সে তত মাই ডিয়ার সিনিয়র। রুমুকেও সেই কাজই করতে হলো। ডিপার্টমেন্ট এবছর শেক্সপিয়রের মৃত্যুবার্ষিকী ঘটা করে পালন করবে। এপ্রিলের তেইশ। এই এলো বুঝি। রুমুর এসবে মন নেই। বাড়ি থেকেও বাড়তি সব কিছু বারণ। সোজা ইউনিভার্সিটি আর বাসা। নো ডান বাম। যার কপাল পুড়েছে শাওনে তার কি আর ভাদ্রের ভয়! ভালো নাম্বার পাবার জন্য প্রায় প্রতিদিনই একবার হলেও ম্যামের বাসায় নাটকের রিহার্সেলে হাজিরা দিতে হয়। রুমু মূলত দর্শক। এসবে তার মন নেই। ঝামেলাটা শুরু হলো ‘ওফেলিয়াকে’ নিয়ে । কে হবে হবে পলিনিয়াসের কন্যা, হেমলেটের প্রেমিকা ওফেলিয়া। আগ্রহ অনেকেরই আছে তবে ম্যামের পছন্দ লম্বা মেয়ে। সিনিয়র ইমরান ভাইয়ার নায়িকা হবার জন্য অধিকাংশ মেয়েরাই হাই হিল পড়ে আসতে লগলো। যত না নায়িকা হবার শখ তার চেয়ে বেশি লোভ নোটসের। ফার্স্ট ক্লাশ ফার্স্ট বলে কথা। রিহার্সেল নিয়মিত এগিয়ে চললো। ওফেলিয়ার ক্যারেক্টার করানো হচ্ছে তিনজনকে দিয়ে। পারফর্মেন্স বিচারে বাছাই করা হবে।
মার্চের শেষ সপ্তাহ। গরম শুরু হয়েছে। মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসের কদম তলায় রিহার্সেল করা শুরু হলো। অভিনয় যেন ঠিকঠাক হয় তা নিশ্চিত করার জন্য বিভাগের সাথে কথা বলে নাট্যকলার দুইজন সিনিয়রকে ডেকে এনে দায়িত্ব দিলেন বিভাগীয় প্রধান। তাদের একজনের নজরে এলো রুমুর দিকে।
ম্যাম এই মেয়েটাকে দিয়ে ট্রাই করে দেখতে পারেন। বেশ লম্বাটে আর হেমলেটের সাথে মানাবে বলে মনে হচ্ছে।
মাঠের একপাশে উদাসী বসে থাকা রুমু কি সেদিন জেনেছিল ওফেলিয়ার মতো করুণ কোনোদিন হয়তো তার জন্য অপেক্ষা করছে? হয়তো সেই এভনের নায়ক এত বছর পরও দক্ষিণ এশিয়ার কোন এক কিশোরীর সাথে একি প্রেমের অভিনয়ে মাত করে দিবে জীবনের করুণ মঞ্চ!
নাটকের দিন সবাই ইমুর প্রশংসা করলো। কী অসাধারণ অভিনয়! নাট্যকলার স্টুডেন্টরাও নাকি এত ভালো পারফর্ম করার কথা না। রুমুর অভিনয় ভালো কি মন্দ হয়েছে তা নিয়ে কেউ তেমন কিছুই বললো না। সে ও যেচে কাউকে জিজ্ঞাসা করতে যায়নি। তবে ম্যাম তাকে ডেকে বলেছিল, সবাই হেমলেটের প্রশংসা করছে, মূলত নাটকে তার ক্যারেক্টারটাই সেন্ট্রাল। তবে আমার মনে হয় হেমলেট আর ওফেলিয়ার মুখোমুখি দৃশ্যে— ইউ ডিজার্ভ দ্যা হাইয়ার এপিসিয়েশন।
রুমু হাসি দিয়ে বাড়ি ফিরেছে। তার অভিনয়ের কথা বাড়িতে কেউ জানে না। বিশেষ করে বাবা জানতে পারলে হয়তো বাড়ি থেকেই বের করে দিবেন। পরদিন ভোরে ফেসবুকে কেউ একজন তাকে পোক করলো। মেসেজ দিলেও তো হয়। পোকের কি প্রয়োজন। ইমু ভাইয়া!
পরদিন ঠিক ভোরে আবার একটা লাইক। পরদিন আবার ইকটা সেড ইমোজি। রুমু কিছুই বলে না। রবিবার ক্যাম্পাসে যাবার বাসে সিটের জন্য যখন একেবারে পেছনের দিকে যাচ্ছিল তাকে কেউ ডাকলো।, এই যে তোমার জন্য সিট রেখেছি।
ততক্ষণে বাসের অনেকগুলো মুখ রুমুকে দেখছে। মাস্টার্সের সিটে বসা উচিত হবে কি হবে না তা ভাবার সময় নেই। ইমুর পাশের সিটেই তাকে বসতে হলো। বাস চলছে। মূলত রুমু বসেছে একটু ডানদিকে ফিরে যেন মুখ না দেখা যায়।
কই কিছু তো বললে না।
আপনিও তো কিছু লেখেননি।
ইমু আর রুমুকে প্রায়ই ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় দেখা যাচ্ছিল। তবে সম্পর্কটা মূলত প্রেমের না সিনিয়র জুনিয়রের ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা। ইমুর `ইন এ রিলেশনশিপ` স্ট্যাটাসে জুনিয়রদের অনেকেই অবাক হলো। রুমুর বিয়ে, এবরশন বিষয়গুলো অনেকের অজানা ছিল না। অনেকে টিপ্পনী কাটা শুরু করলো, দানে দানে দুই দান।
রুমু মূলত একটা ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। আবার প্রেমে পড়ার মতো বিলাসিতা, প্রেম না করার মত কাঠিন্য— কোনোটাই তার মনে স্থির হচ্ছে না। সে নিজেকে আবিষ্কার করলো অচেনা একজন। এক শামুকে তার আবার পা কাটতে মন চাইছে। যেন নিজেকে খুন করার মাঝেই শান্তি। সবচেয়ে বড় ভুলটা হলো সেকেন্ড মিডের দুই দিন আগের এক সন্ধ্যায়। হেমিংওয়ের ভালো নোটস কারো কাছেই ছিল না। ইমুকে নক করতেই পাওয়া গেল নিশ্চয়তা। কিন্তু সেই নোট রুমুকেই গিয়ে নিয়ে আসতে হবে!
তখনো সন্ধ্যা নামেনি। আবছা আলোয় বিকেলের সাথে সন্ধ্যার চোখাচোখি চলছে। দূরের একটা বটগাছ থেকে এদিক-ওদিক কেবলি ফুরুত ফারুত উড়ছে কয়েকটা চড়ুই। রুমুর মা তার স্বামীর সাথে হাসপাতালে ব্যস্ত। ক`দিন ধরে রুমুর আব্বা অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি। দরজায় তালা দিয়ে তাকে একাই বের হতে হলো। তার ইচ্ছা খুব জলদিই সে ফিরে আসবে। কয়েক মিনিটেরই তো পথ। একতলা বাড়ি। বাড়ি না ছাত্রাবাস। বোধহয় কয়েক বন্ধু মিলেই বাসা ভাড়া করে থাকে। ভিতরে যাওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও তাকে যেতে হলো। নোটস নিয়ে ফিরতে সেদিন অনেক দেরি হয়েছিল। রুমু তার ডাইরিতে লাল কলমে লিখেছিল, প্রিয় হেমিংওয়ে তোমার নোটসের ভার বহনের জন্য কেন আর কাউকে খুঁজে পেলে না?
তিন.
ক্যাম্পাসে ছয় বছর কিভাবে যে কেটে গেছে কে জানে! তবে ইউনিভার্সিটির শেষ দিনগুলোতে কিছুতেই ক্যাম্পাস রুমুকে টানতো না। সিনিয়ররা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতো। `খেয়ে ছেড়ে দিছে`—সম্ভবত কানে আসা সবচেয়ে ভদ্র বাক্যগুলোর একটিই ছিল।
রুমুর মা মারা যাবার পর রুমুর বিয়ে দেয়া ছাড়া আমিন সাহেবের আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল না। সামাজিক একটা চাপও ছিল। এদিকে মাস্টার্স শেষ করে প্রাইভেট জবের জন্য যেখানে পারা যায় সেখানেই সিভি জমা দিচ্ছিল রুমু। ফার্স্ট গ্রেড অফিসার থেকে শুরু করে অফিস কাম কম্পিউটার অপারেটর কিছুই বাদ যাচ্ছিল না।
টিনের চালে শীতের কুয়াশা জমতে শুরু করেছে। শিমের ফুলগুলো ধীরে ধীরে হচ্ছে গাঢ় বেগুনি। লাউ মাচার নিচে তাকালে দেখা যাবে ছোট দু একটা কড়া বেজায় দুলছে। এক সকালে রুমু পাকা বড়ই রোদে মেলে দিচ্ছে। যথেষ্ট রোদের অভাবে প্রায় অনেকগুলোই স্যাতস্যাতে হয়ে গেছে। দিলশাদ খালা। রুমুর একমাত্র খালা। মায়ের মৃত্যুর পর প্রায় সপ্তাহ খানেক এখানে ছিলেন। প্রতি রাতেই রুমুকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়েছেন। আজ আবার এলেন সাত মাস পর। রুমু কত দিন গোসল করে না! গোসল তো রোজই করে, হয়তো গায়ে সাবান মাখার কথাটাও মনে থাকে না। সেই কবে ঝর্ণায় ভিজতে ভিজতে গলা ছেড়ে গেয়েছিল তাও মনে নেই। আজ কি আবার গুণ গুণ করে গাইবে সে! হালাল সাবান গায়ে মাখতে মাখতে নিজের শরীরে হাত বোলায় রুমু। আহ শরীর। শাদা। দুধ বর্ণ।
স্বামী প্রাইভেট ব্যাংকের এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। লোন নিয়ে একটা ফ্ল্যাট কিনেছে এরই মধ্যে। একাই থাকে। এবার দুই জনের সংসার। রুমু ঘর গোছায়। এটাইতো চেয়েছিল মেয়েটা। একটা নিজের সংসার। একটা বিছানা। সজনের সাথে টেংরা মাছের ঝোলে হালকা সরষে বাটা। মিজান প্রায়ই বাড়ি ফিরে না। দুই দিন, তিন দিন চলে যায় কোন খোঁজ পাওয়া যায় না। তবে অফিস করে ঠিকঠাক। আজ দুপুরে এক গ্লাস পানি খেয়ে রুমুর সময় কাটছে।
তিন দিন পর এলে?
হু!
হু কি? আমি কি না খেয়ে থাকবো, বাজার সদাই করতে হবে না?
শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করেছি নিজেরটা নিজেরি তো করা উচিত, তাই না?
বিয়ের পর প্রথম বাড়ি যাচ্ছে রুমু। ছয় ঘণ্টার পথ। ট্রেনের যে টিকিট ছিল না তা নয়, তবে সামান্য কয়েক ঘণ্টার জন্য টিকিট কাটাকে মিজানের কাছে বিলাসিতা মনে হয়। রুমুর পড়নে সেই বিয়ের দিনের শাড়ি। তার মায়ের পুরাতন সুন্দর শাড়িটা। আহা কি মা মা গন্ধ! ট্রেন চলছে নান্দিনা, ইসলামপুর, সরিষাবাড়ি আরো কত কত ইশটিশন। রুমু ভাবে তার জীবনটাও এই ট্রেনের মত, কত ইশটিশন যে সে পাড়ি দিল!
মিজানের সাথে ডিভোর্সের ব্যাপারটা মোটেই সহজ ছিল না। আদালতে মামলা করতে গিয়ে আমিন সাহেব দেখেন তার মেয়ের নামে পরকীয়া ও গহনা চুরির মামলা দেয়া আছে প্রায় তিনমাস আগেই! তার মানে মিজান আগে থেকেই সংসারের পরিণতি সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছিল। পাবেই না কেন, যে পুরুষ নিজের মামীর সাথে ছি!
চার.
রুমু কি দরজা খুলবে! এই রতন মাসিই তাকে আশ্রয় দিয়েছে। মানুষ যতই তাকে রতন হিজড়া বলে কুৎসা রটাক সে বের করে দিলে রুমু যাবেই বা কোথায়? রুমু ঘামতেই থাকে। এই মুহূর্তে নিজেকে একটা মাইক্রো ওভেনের মতো উত্তপ্ত মনে হচ্ছে তার। বিছানার নিচে ছোট ট্রাংকে ইসলামপুর স্টেশন থেকে কেনা ফল কাটার বড় চাইনিজ ছুড়িটি রুমুর খুব প্রিয়।
স্বাভাবিক ভাবেই খোলা হলো কাঠের দরজার নিশব্দ কবাট। এখন নিশ্চয়ই অনেক রাত, মানুষের চোখে রাজ্যের ঘুম। রতন মাসি এসে দাঁড়ায় রুমুর খুব কাছে। তার চোখে বিহ্বলতা। ছুরির এক পাশের উজ্জল স্টিলে রুমু নিজেকে দেখতে পাচ্ছে। আশ্চর্য নিজেকে কেমন খুকি খুকি লাগছে তার! রুমুর চুলগুলো কি বিনুন করে বাধা? ওপাশটায় রতন মাসি জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে। সে ও কি রুমুর লম্বা বিনুন দেখতে পাচ্ছে?