অনন্ত সুজন
অনন্ত সুজনের পাঁচ কবিতা
প্রকাশিত : আগস্ট ২৮, ২০২২
ক্ষেত্রফল
গৃহ আজ ধূলিঝড়ে যাবে
তাকে ছেড়ে দাও, মর্মমূল ছিঁড়ে পথের
ধারে শুয়ে থাকা নিথর বৃক্ষটির পাশে।
যেখানে ক্রন্দন বেতারবার্তার মতো লাল
আবেগে সমুদ্রকে জাগিয়ে রাখে!
পাহাড়ের ওপার থেকে কে যেন ডাকে
বুকের ঝাড়খণ্ড দেখেও আগাতে পারি না।
রণবীরের কাছ থেকে ধার করা সাহস কুণ্ডলির
দিকে তাকিয়ে থাকি—চোখ হতে গড়িয়ে নামে
নোনা মার্বেল। শুনেছি, উপত্যকায় যারা থাকে
সেগুলো দিয়ে তারা নাকি শিকারের কাজ চালায়।
সেইসব শব বাহকের মতো, যারা একদিন আমার
হাড়গুলোকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে শীত
নিবারণ করেছিল। প্রগাঢ় পণ্ডিতের ভাষায়—
রূপকথার জন্ম আসলে ওখান থেকেই
অগ্নিমাতালের বেশে যত্রতত্র রেখে যাওয়া জাদুযন্ত্রণা।
আদিবাসীদের কেউ কেউ যারা প্রত্যক্ষদর্শী ছিল—
কথার জাবর কাটতে কাটতে শিশুদের কানে তুলে
দিত অযাচিত ঘুম।
এও জেনেছি, অনেককাল পর—
তাদের লোমকূপে ঝনঝন শব্দে হঠাৎ
গজিয়ে ওঠেছিল সজারুর কাঁটা
খরতাপের নশ্বরে অনুভব করেছে
প্রকাণ্ড এক হিম, যাকে বরফ বলে জানো।
তারপর থেকে পাহাড়ের সাথে খেলা করা
রঙিন শিশুরা আর সমতলে নামেনি!
প্রেম
মুখোমুখি হলেই কৌতুক করো
যেন অংক বোঝো না
আহা, এখনও তুমি অদ্ভুত অসুখ
ভালো হলেই সেরে যাও!
হুমাত্রিক খুন
উড়ে যাও পাখি পেছনে ফেলে স্নেহের আবাসন
দুর্বিপাকের দেশে, দুরারোগ্য ক্ষতেই ভেতরে কিছুই
আর অবশিষ্ট নেই। প্রস্তানের নামে ত্যাগ করো
পরিকীর্ণ শস্যের মোহ। অচেনা ঋতুর অবিচারে
যেভাবে ঝরে পড়ছে পাতা সমবায় আর বৃক্ষদের
বিদীর্ণ চিৎকারে তোমারও বেড়ে যাবে পালকের ব্যথা
তার আগেই গুটিয়ে নাও অবুঝ দেহরত্ন, খেলাঘর।
সেদিনও ছিল শব্দসাহস, আকণ্ঠ কথার ভিড়
সন্ধ্যা হলেই জমে উঠতো অনন্তের নির্মোহ নীড়
কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ ধূমায়িত কালো
বাতাস গ্রাস করলো আমাদের উৎসবের নগরী
ক্লান্তির ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে দেখি—প্রতিটি
স্বাধীন গৃহ এক একটি স্বতন্ত্র কারাবাস!
স্বর্গলোকে নিয়ে যাবে বলে অজস্র সহোদর
সুকৌশলে সওয়ার হয়েছে দূরপাল্লার দূর ঢেউয়ে
তাদের একহাতে কোমল গোলাপ অন্যহাতে মারণাস্ত্র
এবার হস্তবাঁধা প্রজাকুল কোনটা নেবে বলো?
যাও পাখি, উড়ে যাও সুনির্ভর ডানায়
পারো তো সঙ্গে নাও আপাত অভিন্ন মাতৃকুল
এতকাল মানুষ ভেবে যারা নিজেদের স্বনির্ভর
চোখে জমিয়ে রেখেছে নিজেদেরই ঘৃণার জল!
কুরুক্ষেত্র
নিমজ্জনকথা আর কী বলবো—
ত্বকের বিরহ পৌঁছে গেছে হাড়ে!
গতরাতে যে জন্মেছে মানুষরূপে
বোবা না হলে বলতো পিতাকে
যে মাতৃশিকারে গিয়েছিল—
নির্ণয় ভেবে এনেছিল বাষ্প ও বিকার!
শিশু কি জানে, বর্ধমান বনসাই
প্রকল্পের চারপাশে পরিচর্যার
আঙুল হতে গলে পড়ছে পুঁজপাহাড়
এতে করে অতিরিক্ত ভারবাহী
গাধাদেরই সুনাম বাড়ে!
কে তুমি? লুপ্ত হবার ভয়ে
নিজেরই মাংসে বসিয়ে দিলে
জিজ্ঞাসার ছুরি! অনর্গল রক্তের
খবর পেয়ে বনের স্তব্ধতা ভেঙে
নেমে এলো শকুন
উত্তরের খোঁজে বাগানমালি
ডাকঘর হতে নালিশশূন্য ফিরে
আসে। প্রশ্নের দায়ভার উল্টে গিয়ে
ফাঁদপাতা ফলা হয়ে সিমারের ভূমিকায়
দিন আর রাত্রিকে জখম করে চলে।
বেষ্টনি ভেঙে কুঁড়ির ভেতর থেকে
গজিয়ে ওঠে তার অবাক রূপান্তর
জন্ম ও আয়ু সেইসব মুখোশের আড়ালে
পাতানো প্রেমের খসড়াসহ
যারা চলে গেছে মসজিদ, মন্দিরে
তাতে বেড়ে যায় অনিচ্ছুক পতনরীতি
পাতা ও পাপড়িদলে। প্রতিটি পুষ্পহত্যা
তাই জাদুঘরে রাখার মতো।
সময়
ঝরে পড়ছে নিম-পরাগ, বিবৃতি জানে না উড়াল।
তাই, প্রান্তরের রেখা অতিক্রম করে লাগামহীন
আহত ঘোড়ার মতো নিরুদ্দেশ হয়েছে।
হঠাৎ উদিত ঝিল্লি তাদের করুণায় প্রবাহিত।
মলিন, মন্থর এ সময় বুঝি আমার নয়!
ধূলিকণায় বিবাদের যন্ত্রণা বাড়িয়ে—
এ আমি নিতান্তই আড়াল শোভাকর।
বিস্ময়-চিহ্নের নিচে যাপিত কোন বিসর্গবিন্দু।
সতীর্থ স্রোতে যত সব দাঁড়ি-কমা আর প্রাজ্ঞ সেমিকোলন—
শুধুই সম্পর্কসেতু নির্মাণ করে
মহাকালের গ্রীবায় তুলে দিচ্ছে—অহেতুক জঞ্জাল।
ডাক দিয়ে বুঝিয়ে বলেছে আমায় শিল্পের প্রকার।
সেইসব মুখ ও মুখোশ—যারা অভিনয়ে পারঙ্গম—
কুড়ায় কংকাল, জপে সারাক্ষণ অপদেবতার নাম।