অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর গল্প ‘নুরবানু’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৯, ২০২১

কবি, কথাসাহিত্যিক ও সম্পাদক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের আজ মৃত্যুদিন। ১৯৭৬ সালের ২৯ জানুয়ারি কলকাতায় তিনি মারা যান। ১৯০৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পিতার কর্মস্থল নোয়াখালীতে তার জন্ম। রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের পরে সাহিত্যজগতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী কল্লোল যুগের লেখকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে ‘নূরবানু’ গল্পটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

কুরমান হাটে কাঁচের চুড়ি কিনতে এসেছে। মেজাজ খুব খারাপ। গা এখনো কশকশ করছে। তবু এ-দোকান থেকে ও দোকানে সে ঘোরাঘুরি করে। সোনালী কিনবে না বেগুনী কিনবে চট করে ঠাওর করতে পারে না। অন্যদিন হাটে এসে তামাক কিনতো, লঙ্কা-পেঁয়াজ কিনতো, তিত-পুঁটি বা ঘুসো চিংড়ি। আজ তাকে কাঁচের চুড়ি কিনতে হচ্ছে। কিনতে হচ্ছে চুলের ফিতে।

চুড়ির সোয়া তিন আঙুল জোখা। চুড়ির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে-ঢুকিয়ে দেখে কুরমান। জোখা মেলে তো রঙ পছন্দ হয় না, রঙ মনে ধরে তো জোখায় গরমিল। নুরবানুর কাঁচের চুড়ি সে আজ ভেঙে দিয়ে এসেছে। ফিতে ধরে টানতে গিয়ে খুলে দিয়েছে চুলের খোঁপা। চোট-জখম লেগেছে হয়তো এখানে-ওখানে।

জমি-জায়গা নেই, কর-কবুলত নেই, বর্ষায় চাষ করে কুরমান। তাও লাঙল কিনে আনতে হয় পরের থেকে। ধান-যা-ও হয়েছিল গত সন, পাখিতে খেয়ে নিয়েছে, খেয়ে নিয়েছে ইঁদুরে। এ বছর গাছ হয়েছে তো শিষ হয়নি। ডোবা জমি, নোনা কাটে না ভালো করে। যা ধান হয়েছে দলামলা করে মনিবের খাস খামারে তুলে দিয়ে আসতে হবে। সে পাবে মোটে তিন ভাগের এক ভাগ।

বড়ো দুর্বল অবস্থা তাদের। না আছে থান না আছে থিত। তাই কুরমানের একার খাটনিতে চলে না। নুরবানুকেও কাজ করতে হয়। নুরবানু মনিবের বাড়িতে ধান ভানে, পাট গুটোয়, কথা কাপড় কাচে, জল টানে। আর মনিব গিন্নীর খেজমত করে। চুল বাছে, গা খোঁটে, তেল মাখে। ভালো মন্দ খেতে পায় মাঝে-মাঝে। দরমা পায় চার টাকা! কিন্তু শান্তি নেই। মনিব উকিলদ্দি দফাদার, নুরবানুকে অন্যায় চোখে দেখেছে।

প্রথম দিনেই নালিশ করেছিল নুরবানু : মুনিব আমাকে অন্যায় চোখে দেখে।
‘কেন কি করে?’
‘খুক খুক করে কাশে, বাঁকা চোখে তাকায়, আমোদ-সামোদ করে কথা কয়।‘
‘তুই ওর ধারাধারি যাসনে কোনদিন।‘
‘না, আমি ঘোমটা টেনে চলে যাই দূর দিয়ে।‘

কিন্তু দফাদার তাতে ক্ষান্ত হয়নি। একদিন নুরবানুর হাত চেপে ধরলো। সেদিনও কাঁদতে কাঁদতে নুরবানু বললে, হাত ছাড়িয়ে নেবার সময়ে খামচে দিয়েছে।

রাগে শরীরের রগগুলো টান হয়ে উঠলো কুরমানের। বললে, তুই সামনে গেছিলি কেন?
‘কে বললে? যাইনি তো সামনে।‘
‘সামনে যাসনি তো হাত চেপে ধরে কি করে?’
‘আমি ছিলাম টেকি-ঘরে। ও ঘরে ঢুকে বললে, বীজ আছে ককাটি? আমি পালিয়ে যাচ্ছি পাছ দুয়ার দিয়ে, ও খপ করে আমার হাত চেরে ধরলো।

তবু সেদিনও সে মারেনি নুরবানুকে। নিজের অদৃষ্টকেই দোষ দিয়েছিল। আশ্চর্য গরিবের বউ-এর কি একটু স্নও থাকতে পারবে না? গরিব বলে স্ত্রীর বেলায়ও কি তাদের অনুভব আর উপভোগের মাত্রাটা নামিয়ে আনতে হবে?

‘খবরদার, সামনে যাবি না ওর। ওরা জোরমন্ত লোক, থানা-পুলিস সব ওদের হাতে, ওদের অনেকদূর দিয়ে আমাদের হাঁটা চলা। কাজ কাম সেরে ঝপ করে চলে আসবি।’

কিন্তু আজ ওর হাত-ভরা কাঁচের চুড়ি। ফিতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বিনুনি পাকানো। হাসিতে ভেসে যাচ্ছিল নুরবানু, কুরমানের মুখের চেহারা দেখে ঝিম মেরে লো।
‘এব কোত্থেকে?’
‘মুনিব গিন্নী দিয়েছে।‘
কিন্তু জিগেস করি, পয়সা কার? এ সাজানোর পেছনে কার চোখের সায় রয়েছে লুকিয়ে? আজ কাঁচের চুড়ি, কাল আংটি-চুংটি। নোনা জমি এমনি করেই আস্তে আস্তে মিঠেন করে তুলবে। হাত ধরেছিল, ধরবে এবার গলা জড়িয়ে।

‘খুলে ফেল শিগগির।’ গর্জে উঠলো কুরমান। সাজবার ভারী সখ নুরবানুর। একটু সে হয়তো টাল মাতাল করেছিল, কুরমান হাত ধরে হেঁচকা টান মারলো। পট পট করে ভেঙে গেলো কতগুলি। হেঁচকা টান মারলো খোঁপায়। একটা কুণ্ডলী পাকানো সাপ কিলবিল করে উঠলো।

ডুকরে কেঁদে উঠলো নুরবানু। চুরি ধারে জায়গায় জায়গায় হাত কেটে গিয়েছে। চামড়া ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে রক্ত। ঘরের পুরুষের এমন দুর্দান্ত চেহারা দেখেনি সে আর কোনদিন। বাবা, ভয় করে। দরকার নেই তার চুড়ি-খাড়ুতে, কিষাণের বউ সে, ঠুটো পাথর হয়ে থাকবে। সাধ-আমোদে তার দরকার কি।

কিন্তু একি! হাটের থেকে তার জন্যে চুড়ি নিয়ে এসেছে কুরমান। লঙ্কা-পেঁয়াজ তামাক-টিকে না এনে। লজ্জায় গলে যেতে লাগলো নুরবানু। পাঁচ আঙুলের মুখ একসঙ্গে ঘুচলো করে চেপে ধরে কুরমান! টিপে টিপে আস্তে আস্তে চুড়ি পরিয়ে দেয়। হঠাৎ রাগে মাথা ঘুরে গিয়েছিলো তার। নইলে এমন যার তুকতুকে হাত তার গায়ে সে হাত তোলে কি করে?

‘তুমি কেন মিছিমিছি বাজে খরচ করতে গেলে? এদিকে তোমার একটা ভালো গামছা নেই লুঙ্গিটা ছিঁড়ে গেছে।‘
‘যাক সব ছিঁড়ে-ফেড়ে। তুই শুধু একবারটি হাস আমার মুখের দিকে চেয়ে।‘
পিঠে চুলগুলি খোল পড়ে আছে ভুর করে।
‘তোর চুল বাঁধা দেখিনি কোনোদিন–,
আজ শুধু দেখে না কুরমান, শোনেও। শোনে চুল বাঁধার সঙ্গে সঙ্গে চুড়ির ঠুন-ঠুন।

উকিলদ্দির বাড়িতে তবু না গেলেই নয় নুরবানুর। চারটে টাকা কি কম? কম কি এক বেলার খোরাকি? ধান-পান যদি পায় ভবিষ্যৎ, তাই কি অগ্রাহ্য করবার? কিন্তু সেদিন নুরবানু উকিলদ্দির বাড়ি থেকে নতুন সাড়ি পরে এলো। ফলসা রঙের শাড়ি। নুরবানুর বর্ণ যেন ফুটে বেরুচ্ছে।

‘এ শাড়ি এলো কোত্থেকে?’ বর্শার মুখের মতো চোখা হয়ে উঠলো কুরমান।
‘আজ যে ঈদ খেয়াল নেই তোমার? ঈদের দিনে মুনিব-গিন্নী দিয়েছে শাড়িখানা।
ঈদের দিন হলেও নরম পড়লো না কুরমান। ফিরনি-পায়েসের ছিটেফোঁটাও নেই, নতুন একখানা গামছা হয় না, ঈদ কোথায়?
না, নরম পড়লো না কুরমান। শাড়ির প্রত্যেকটি সুতোয় দেখতে পাচ্ছে সে উকিলদ্দির ঘোলা চোখ, ঘষা জিভ। ফাঁই ফাঁই করে সে শাড়িটা ছিঁড়ে ফেললো।

এবার আর সে হাটে গেলো না পালটা শাড়ি কিনে আনতে। পয়সা নেই, ইচ্ছেও নেই। ক্ষুদ্র চাষা, তার বউয়ের আবার সাইবানী হবার সখ কেন? চট মুড়ি দিয়ে থাকতে পারে না সে ঘরের কোণে? সত্যি, এতো সাজ তার পক্ষে অসাজস্ত ছিল। বুঝতে দেরি হয় না নুরবানুর। কিন্তু তখন কি সে বুঝতে পেরেছে শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে সাপ রয়েছে লুকিয়ে? গা বেয়ে বেয়ে শেষকালে বুকের মধ্যে ছোবল মারবে? নুরবানু তার কালো ফুলের ছাপ মারা কালো শাড়িই পরে এবার। তার রাত্রে এ নিরিবিলি শান্তির মতোই এ শাড়িখানা। তাই ঘুমের স্রোতে স্বচ্ছন্দে চলে আসতে পারে সে স্বামীর স্পর্শের ঘেরের মধ্যে। ফলসা রঙের শাড়িটার জন্যে তার এতটুকুও কষ্ট নেই।

কুরমান কাজ থেকে ছাড়িয়ে আনলো নুরবানুকে। নিয়ে এলো পর্দার হেপাজতে। উপাসে-তিয়াসে কাটবে বু পাপের পথের পাশ দিয়ে হাঁটবে না। দারিদ্র্য লাগুক গায়ে, তবু অধর্ম যেন না লাগে। অদিন এলেও যেন না অমানুষ বনে যায়। কিন্তু উকিলদ্দি ছিনে-জোঁক। বয়স হয়েছে কিন্তু বিবেচনা নেই।

ধান কাটতে মাঠে গিয়েছে কুরমান। লক্ষ্মীবিলাস ধান কাটবার দিন এখন। পা টিপে টিপে দুপুরবেলা উকিলদ্দি এসে হাজির। কানের জন্যে ঝুমকো, পায়ের জন্যে পঞ্চম, গলার জন্যে দানাকবজ নিয়ে এসেছে গড়িয়ে। বললে, কই গো বিবিজান। দেখো এসে কী এনেছি।

বেরিয়ে আসতে নুরবানুর চক্ষু স্থির। রুপোর জেওর দেখে নয়, চোখের উপরে বাঘ দেখে। অনেক ভয়-ডর নুরবানুর। এক নম্বর মালেক, দুই নম্বর মুনিব। তিন নম্বর দফাদার। চার নম্বর একটা মাংসখেকো জানোয়ার।

‘চলে যান এখান থেকে।‘ চোখে মুখে আঁচ ফুটিয়ে ঝাপসা গলায় বললে নুরবানু।
‘তোমার জন্যে লবেজান হয়ে আছি। এই দেখো, জেওর এনেছি গড়িয়ে।‘
‘দরকার নেই। আপনি চলে যান। নইলে সোর তুলবো এখুনি।‘

কিন্তু সোর তুলবার আগেই কুরমান এসে হাজির। রোদে সে তেতে-পুড়ে এসেছে, চোখে ঘোলা পড়েছে বোধ হয়। নইলে দেখছে সে কী তার বাড়ির উঠোনে? উকিলদ্দির হাতে রুপোর গয়না আর নুরবানুর চোখে খুশির ঝলকানি, কত না জানি ঠাট্টাবটকেরা, কতো না জানি হাসির বুজরুকি। রঙ সঙ আমোদ-বিনোদ। এই গয়নাতে কত না জানি যোগসাজসের শর্ত। মাথায় খুন চেপে গেলো কুরমানের, চারপাশে চেয়ে দেখলো সে অসহায়ের মতো। দেখলো ধানের আঁটির সঙ্গে কাচি সে ফেলে এসেছে মাঠে।

‘এখানে কেন?’
ধানাই-পানাই করতে লাগলো উকিলদ্দি। শেষকালে বললে, লক্ষ্মীবিলাস ধান কাটাত গিয়েছিস কিনা দেখতে এসেছিলাম।
‘তা মাঠে না গিয়ে আমরা বাড়ির অন্দরে কেন?’
‘বেশ করেছি। সমস্ত জায়গা-জমি সদর-অন্দর আমার, আমার যেখানে খুশি আমি যাবো আসবো।‘

কুরমান হঠাৎ উকিলদ্দির দাড়ি চেপে ধরলো। লাগলো ঝটাপটি, ধস্তাধস্তি। উকিলদ্দির হাতে যে লাঠী ছিল দেখেনি কুরমান। তা ছাড়া কুরমান আধপেটা খাওয়া চাষা, জোর জেল্লা নেই শরীরে সেটাও সে বিচার করে দেখেনি। উকিলদ্দি তাকে ধাক্কা মেরে ফেলেতো দিলই, তুলে নিল লাঠিগাছটা।। কুরমানকে দেখেই ঘরের মধ্যে লুকিয়েছিল নুরবানু। এখন মারমুখো লাঠি দেখে। বেরিয়ে এলো সে হন্তদন্ত হয়ে, শিরে পাখির মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো উকিলদ্দির উপর। লাঠিটা ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করলো জোর করে। মুঠো আলগা করতে পারে না। শুধু শুরু হয় লটপাট।

কি চোখে দেখলো ব্যাপারটা কে জানে কুরমানের রক্তের মধ্যে ঝড় বয়ে গেলো। এক ঝটকায় টেনে আনতে গেলে নুরবানুকে চুলের কুঁটি ধরে : ‘তুই, তুই কেন বেরিয়ে এসেছিল পর্দার বাইরে। কেন পর-পুরুষের সঙ্গে জাপটাজাপটি শুরু করে দিয়েছিস?’ উকিলদ্দিকে রেখে মারতে গেলে সে নুরবানুকে। আর যেমনি এলো এগিয়ে, হাতের নাগালের মধ্যে, অমনি উকিলদ্দির লাঠি পড়লো কুরমানের মাথায়। মনে হলো নুরবানুই যেন লাঠি মারলো। মনে হলো কুরমানের মারের থেকে উকিলদ্দিকে বাঁচাবার জন্যেই তার এই জোটপাট। উকিলদ্দির গায়ে পড়ে তাই এত সাধ্য সাধনা।

কুরমান দিশেহারার মতো চেঁচিয়ে উঠলো : ‘এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক-বাইন। ব্যস, উথল-পাথল বন্ধ হয়ে গেলো মুহূর্তে। সব নিশ্চপ, নিঃশেষ হয়ে গেলো। রাগ ভুলে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো কুরমান। হাজার লাঠি পড়লেও এমন চোট লাগতো না। আঁধার দেখতে লাগলো চারদিকে।

নুরবানুর সেই রাগরাঙা মুখ ফুসমন্তরে ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেলো। ফকির ফতুরের মতো তাকিয়ে রইল ফ্যালফ্যাল করে। আর মাটি থেকে লাঠিটা তুলে নিয়ে চাপা সুখে হাসতে লাগলো উকিলদ্দি। লোক জমতে শুরু করলো আস্তে-আস্তে।

কুরমান গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়লো। বললে নুরবানুকে, ও কিছু হয়নি, চলে যা ঘরের মধ্যে। সত্যিই যেন কিছু হয়নি, এমনি ভাবেই আঁচল গুটিয়ে চলে গেলো ঘরের মধ্যে, ঘরের বউ-এর মতো।

কিছু হয়নি বললেই আর হয় না। আস্তে আস্তে বসে গেলো দশ-সালিশ। তালাক-দেওয়া স্ত্রী এখন আলগা-আলগোছ মেয়েলোক। তার উপর আর পূর্ব স্বামীর এক্তিয়ার নেই। এক কথায় অমনি আর তাকে সে ঘুরে তুলতে পারে না। বিয়ে ফস্ত হয়ে গেছে, অমনি আর তাকে নেয়া যায় না ফিরতি। অমন হারামি সমাজ বরদাস্ত করতে পারে না। উকিলদ্দি দাঁত বার করে হাসতে লাগলো।

‘রাগের মাথায় ফস করে কথা বেরিয়ে গেছে মুখের থেকে, অমনি আমার ইস্ত্রি পর হয়ে যাবে?’ কুরমান কেঁদে উঠলো। পর বলে পর! এপার থেকে ওপার! একবার যখন বিয়ে ছাড়ার ফারখৎ জারি করেছে তখন আর উপায় নেই। ঘুড়ি কাটা পড়লে নাটাই গুটিয়ে কি ঘুড়িকে ধরে আনা যায়?

‘মুখের কথাটাই বড়ো হবে? মন দেখবে না কেউ?’ মুখের জবানের দাম কি কম? রঙ-তামাশা করে বললেও তালাক তালাক। আর এ-তো জল-জীওস্ত রাগের কথা, গলা দরাজ করে দিন-দুপুরে তালাক দেওয়া।

‘আর দস্তুরমতো সাক্ষী রেখে।‘ ফোড়ন দিল উকিলদ্দি।
‘এখন উপায়? নুরবানুকে আমি ফিরে পাবো না?’
এক উপায় আছে। দশ-সালিশ বসলো ফরমান দিতে। ইদ্দতরে পর কেউ যদি নুরবানুকে বিয়ে করে তালাক দেয় তবেই ফের কুরমান নিকে করতে পারে তাকে। এ ছাড়া আর কুরমানের পথ নেই।

কে বিয়ে করবে? কুরমানকে ফিরিয়ে দেবার জন্যে কে বিয়ে করবে নুরবানুকে? আর কে! দাড়িতে হাত বুলুতে বুলুতে উকিলদ্দি বললে, আমি বিয়ে করবো। কিন্তু বিয়ে করেই তক্ষুনি-তক্ষুনি তালাক দিতে হবে। কথার খেলাপ করলে চলবে না। দশ সালিশের হুকুম মানতে হবে। এর মধ্যে আছে খাদেম-ইমাম, মোন্না মুনশী, ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট, মানী-গুণী লোক সব। এদেরকে অমান্য করা যাবে না।

একটু যেন বল পেলো কুরমান। কিন্তু তার বাড়িতে থাকতে পারবে না আর নুরবানু। বিরানা পর-পুরুষের ঘরে কি করে থাকতে পারে সমৰ্থ বয়সের মেয়েছেলে? পাশ-গাঁয়ে তার এক চাচা তাছে, বেচারী নাচার, সেখানে সে থাকবে। ইদ্দতের তিন মাস। এক কাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলো নুরবানু। যেন কুরমানকে গোর দেওয়া হয়েছে। পুঁতে রেখেছে মাটির নিচে।

তাছাড়া আর কি? কুরমানের হাতের নাগালের মধ্যে দিয়ে চলে গেলো, লু হাত বাড়িয়ে তাকে সে ধরে রাখতে পারলো না।। সামান্য ক’টা মুখের কথা এমনি করে সব নাস্তানাবুদ করে দিতে পারে এ কে জানতো! কুরমানের নিজের রাগ নিজেকে যেন কুরে কুরে খাচ্ছে।

দাউল হয়ে কুরমান চলে গেলো দক্ষিণে। নুরবানু ছাড়া তার আর ঘরদুয়ার কি! ঘরের উইয়ে খাওয়া পাটঘড়ির বেড়া ভেঙে-ভেঙে পড়ছে, তেমনি ভেঙে-ভেঙে পড়ছে। তার বুকের পাঁজরা। চলে গেছে দক্ষিণে, কিন্তু মন কেবল উত্তরে ভেসে-ভেসে বেড়ায়।

ধান কাটা সারা হয়ে গেছে, নিজের গাঁয়ে ফিরে আসে কুরমান। গাঁয়ের হালট ধরে নিজের বাড়িতে। ঘরের ঝাপ খোলে। কোথায় নুরবানু? চৈতী মাঠের মতো বুকের ভিতরটা খাঁ-খাঁ করে। কিন্তু রাত করে লুকিয়ে একদিন আসে নুরবানু। যেন একটা অন্যায় করছে এমনি চেহারায়। কুরমানের থেকে অনেক দূরে সরে বসে আঁচলে চোখ চাপা দিয়ে কাঁদে।

কুরমান বুঝি ঝাঁপিয়ে ধরতে চায় নুরবানুকে। ইচ্ছে করে কোলের কাছে বসিয়ে হাত দিয়ে চোখে জল মুছে দেয়। নুরবানু বলে, না। এখনো হালাল হইনি। ইদ্দত কাবার হয়নি। হয়নি ফিরতি বিয়ে, ফিরতি তালাক।

বলে ‘তোমাকে শুধু একবার দেখতে এলাম। বড়ো মন কেমন করে।‘ বড়ো কাহিল হয়ে গেছে নুরবানু। বড়ো মন-মরা। গায়ের রঙ তামাটে হয়ে গেছে। জোর-জুলুস মুছে গেছে গা থেকে।

এটা-ওটা একটু-আধটু গোছগাছ করে দেয় নুরবানু। ঘরের মধ্যে নড়ে-চড়ে। ‘তোকে কি আর ফিরে পাবো নুরু?’

‘নিশ্চয়ই পাবে। দশ-সালিশের বৈঠকে চুক্তি হয়েছে, কড়ায় ক্রান্তিতে সব আদায়-উশুল হয়ে যাবে। চোখ বুজে এক ডুবে মাঝখানের এই কয়েকটা দিন শুধু কাটিয়ে দেওয়া।‘

‘আমার কি মনে হয় জানিস? ও তোকে আর ছাড়বে না। একবার কলমা পড়া হয়ে গেলেই ও ওর মুখে কুলুপ এঁটে দেবে। বলবে, দেব না তালাক।’

‘ইস!’ নুরবানু ফণা তুলে ফেঁস করে উঠলো : ‘দশ-সালিস ওকে ছাড়বে কেন?
না ছাড়লেই কি, ও পষ্ট গরকবুল করবে। এ নিয়ে তো আর আদালত চলবে। বলবে, কার সাধ্য জোর করে আমাকে দিয়ে তালাক দেওয়ায়।
‘ইস, করুক দেখি তো এমন বেইমানি।‘ আবার ফেঁস করে ওঠে নুরবানু : ‘বেতমিজকে তখন বিষ খাইয়ে শেষ করব। ওর বিষয়ের অংশ নিয়ে এসে সাদি করব তোমাকে।‘

নুরবানুর চোখে কত বিশ্বাস আর স্নেহ। ‘গা-টা তেতো-তোতো করছে, জ্বর হবে বোধ হয়।‘ গায়ে হাত দিতে যাচ্ছিল নুরবানু। হাত গুটিয়ে নিল ঝট করে। অমন সোনার অ স্পর্শ করার তার অধিকার নেই।

একেক দিন গহিন রাতে কুরমান যায় নুরবানুর ঘরের দরজায়। নুরবানুর চোখে ঘুম নেই। বেড়ার ফাঁকে চোখ দিয়ে বসে থাকে। বলে, কেন পাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছ? লোকে যে চোর বলবে। চৌকিদার দেখলে চালান দেবে।
‘কবে আসবি?’
‘দফাদার লোক নিয়ে এসেছিল। আসছে জুম্মাবার কলমা পড়বে। তারপরেই তালাক আদায় করে নেব ঠিক। এখন বাড়ি যাও।‘
কোথায় বাড়ি! কুরমানের ইচ্ছে করে পাখিটাকে বুকের উমে করে উড়াল দিয়ে চলে যায় কোথাও! কোথায় তা কে জানে। যেখানে এত প্যাঁচ-ঘোঁচ নেই, যেখানে শুধু দেদার মাঠ দেদার আসমান।
শিগগির বাড়ি যাও, কুরমান চোর, কুরমান পরপুরুষ।

জুম্মাবারে বিয়ে হয়ে গেলো, কিন্তু, কই, শনিবারে তো তালাক নিয়ে চলে এলো না নুরবানু। যা সে ভেবে রেখেছে তাই হবে। একবার হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়ে উকিলদ্দি আর ছেড়ে দেবে না নুরবানুকে। গলা টিপে ধরলেও তার মুখ থেকে বার করানো যাবে না ঐ তিন অক্ষরের তিন কথা। বলবে, মরণ ছাড়া আর কারুর সাধ্য নেই আমাদের বিচ্ছেদ ঘটায়। কুরমান খোঁজ নিতে গেলো। দাবিদারের মতো নয়, দেনদারের মতো। উকিলদ্দি বললে, আমার কোনো কসুর নেই। বিয়ে হয়েছে তবু নুরবানু এখনো ইস্ত্রী হচ্ছে না। ইস্ত্রী না হলে তালাক হয় কি করে?

যতসব ফাঁকিজুঁকি কথা। তার আসল মতলব হচ্ছে নুরবানুকে রেখে দেবে কবজার মধ্যে। অষ্টঘড়ির বাঁদি করে। কুরমান দশ-সালিশ বসালো। জানালো তার ফরিয়াদ। ডাকো উকিলদ্দিকে। জবাব কি তার? কেন এখনো ছাড়ছে না নুরবানুকে? কেন এজাহার খেলাপ করছে?

উকিলদ্দি বললে, বিয়েই এখনো সিদ্ধ হয়নি, ফলন্ত-পাকন্ত হয়নি। এখনো মাটির গাঁথনিই আছে, হয়নি পাকাঁপোক্ত। বিয়ে হয়েছে অথচ এড়িয়ে এড়িয়ে চলছে নুরবানু। ধরাছোঁয়া দিচ্ছে না। শুতে আসছে না দরজায় খিল দিয়ে ভেবেছে কলমা পড়ার পরেই বুঝি ও তালাকের কাবিল হলো। তাই রয়েছে অমন কাঠ হয়ে, বিমুখ হয়ে। এমনি যদি থাকে, তবে কাটান-ছিড়েন হতে পারে কি করে?

সত্যিই তো। দশ-সালিশ রায় দিলো। স্বামীর সঙ্গে একরাত্রিও যদি সংসার না করে তবে বিয়ে জায়েজ হয় কি করে? বিয়ে পোক্ত না হলে তালাক চলে না। হালাল হওয়া চলে না নুরবানুর। উপায় নেই, হালাল হতে হবে নুরবানুকে। তালাক মেনে নিতে হবে ভিক্ষুকের মতো।

ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিলো নুরবানু। পরদিন ভোরে পাখিপাখলা ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই উকিলদ্দি নুরবানুকে তালাক দিলো। বিকেলের রোদ উঠোনটুকু থেকে যাই যাই করছে, নুরবানু চলে কুরমানের বাড়িতে। কুরমান বসে আছে দাওয়ার উপর। হাতের মধ্যে হুঁকো ধরা কিন্তু কলকেতে আগুন নেই। কখন যে নিবে গেছে কে জানে। চেয়ে আছে-শুনা মাঠের মতো চাউনি। গায়ের বাঁধন সব ঢিলে হয়ে গেছে, ধস ভেঙে পড়েছে জীবনের। ভাঙন নদীর পারে ছাড়া বাড়ির মতো চেহারা।

যেন চিনি অথচ চিনি না, এমনি চোখে কুরমান তাকালো নুরবানুর দিকে। তার চোখে গত রাতের সুর্মা টানা, ঠোঁটে পান-খাওয়ার শুকনো দাগ। সমস্ত গায়ে যেন ফুর্তির আতর মাখা। পরনে একটা জামরঙের নতুন শাড়ি। পরতে-পরতে যেন খুশির জলের স্রোত। সে জল বড় ঘোলা। লেগেছে কাদা মাটির ময়লা। পচা দামের জঞ্জাল। মড়ার মাংসের গন্ধ।।

সে জলে আর স্নান করা যায় না। ইদ্দত আমি এখানেই কারবার করবো। দিন হলেই মোল্লা ডেকে কলমা পড়িয়ে নাও তাড়াতাড়ি। নুরবানু ঘরের দিকে পা বাড়ালো। নেবা হুঁকোয় টান মারতে মারতে কুরমান বললে, ‘না। আমার নিকে-সাদিতে আর মন নেই। তুই ফিরে যা দফাদারের বাড়িতে।’