রাহমান চৌধুরীর প্রবন্ধ ‘শিক্ষক এবং জ্ঞানচর্চার ধারা’
ছাড়পত্র ডেস্কপ্রকাশিত : অক্টোবর ১০, ২০২৩
সত্যিকারের একজন শিক্ষক কাউকে কিছু গিলিয়ে দেবেন না। নিজের মতামত চাপিয়ে দেবেন না। নিজের মতামত প্রতিষ্ঠা করবেন না। নিজের বিশ্বাস বা মতামত চাপিয়ে দিলে শিক্ষার্থীরা বিশেষ ছাঁচে গড়ে উঠবে। বিশ্বের বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার লক্ষ লক্ষ মানুষের অভিজ্ঞতা আর জ্ঞানের যোগফলেই গড়ে উঠেছে। বিশেষ একজন শিক্ষকের মত শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হলে, বিশাল সেই জ্ঞানভাণ্ডার থেকে শিক্ষার্থীর দৃষ্টিকে সরিয়ে রাখা হবে। শিক্ষক নিজের বিশ্বাস চাপিয়ে না দিয়ে বিশ্বের বিপুল জ্ঞানভাণ্ডারের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেবেন। শিক্ষক সেইসঙ্গে শিক্ষালাভের উপায় বা জ্ঞান অর্জনের পথ বাতলে দেবেন। তিনি শিক্ষার্থীর মনে বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা এবং যুক্তিবাদের ধারণাগুলি স্পষ্ট করবেন।
শিক্ষার্থীর চিন্তাধারা এবং যুক্তিবোধকে শানিত করবেন। তিনি শিক্ষার্থীকে কিছুই শেখাবেন না, কিন্তু কীভাবে শিখতে হয় সেসম্পর্কে ধারণা দেবেন। তিনি নিজের অর্জিত শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতার কথা শিক্ষার্থীদের বলবেন। তিনি তা বলবেন, সকলকে সেই পথে চলার জন্য নয়। শিক্ষক তার নিজের অভিজ্ঞতা আর অর্জিত জ্ঞানের কথা বলবেন শিক্ষার্থীদের সেসব ছাড়িয়ে নতুন করে আরো নতুন জ্ঞানকে জানতে উৎসাহিত করার জন্য।
প্রাচীন গ্রীসের এবং রোমের মনীষীদের গড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘একাডেমির’ ধারণাগুলি তেমন ছিল। সক্রেটিসের চিন্তা পদ্ধতিকে ঘিরে সেগুলো গড়ে উঠেছিল। সক্রেটিস কখনো কাউকে কিছু শেখাতেন না। নিজের মত গিলিয়ে দিতেন না। তিনি প্রচলিত মতগুলো নিয়ে প্রশ্ন করতেন। তিনি প্রশ্ন করার মধ্যে দিয়ে এটাই প্রমাণ করতেন জ্ঞান কোনো গণ্ডীবদ্ধ ধারণা নয়। প্রশ্নের পর প্রশ্ন তুলে সেই জ্ঞানভাণ্ডারকে আরো বিকশিত করা যায়। সক্রেটিসের শিষ্য প্লাটো তাই ধার্মিক হয়েও বিজ্ঞান নিয়ে উন্নত চিন্তা করতে পেরেছিলেন। কারণ গুরুর কাছ থেকে তিনি প্রশ্ন করার ধারণাটা গ্রহণ করেছিলেন। নতুন প্রশ্ন নতুন মত তৈরি করে। প্লাটো সেভাবেই তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রিপাবলিক’ লিখেছিলেন। দুহাজার বছরের আগের সেই গ্রন্থটি আজও বিশ্বের রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মূল্যবান সম্পদ। কারণ এ নয় যে, প্লাটো সব সত্য সেখানে বলে গেছেন। কিন্তু রাষ্ট্র নিয়ে কিছু মৌলিক প্রশ্ন তুলেছিলেন। তিনি তাঁর সময়ে রাষ্ট্র সম্পর্কে যতোটা মৌলিক প্রশ্ন তোলা সম্ভব সেইটুকু তুলে তাঁর একটা জবাব লিপিবদ্ধ করে গেছেন।
প্লাটোর শিষ্য অ্যারিস্টটল তাঁর সময়ে প্লাটোর রিপাবলিকের চিন্তাগুলো সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছিলেন, গুরুর চিন্তার বিপরীতে নিজের মতামত সেখানে আলাদা গ্রন্থে আলোচনা করেছেন। জ্ঞানের জগত সেভাবেই এগিয়ে গেছে। যদি অ্যারিস্টটল তখন প্লাটোর মতকে অনড় বা চিরসত্য মনে করে শুধু তাই তার ছাত্রদের শেখাতেন, তাহলে জ্ঞানের জগতে অচলায়তন তৈরি হতো। জ্ঞান আগাতে পারতো না। প্লাটোর মূল্যবান জ্ঞান নিয়ে অ্যারিস্টটল এবং অন্যরা নানা রকম প্রশ্ন তুলেছেন বলেই, প্লাটো আজ বড় মাপের দার্শনিক। যদি প্লাটোর চিন্তা নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন তোলা না যেতো, কিংবা প্রশ্ন তুলতে নিষেধ করা হতো, তাহলে তা ধর্মগ্রন্থে রূপান্তরিত হতো। প্লাটো দার্শনিক না হয়ে হতেন পয়গম্বর।
প্লাটো পয়গম্বর হতে চাননি। দার্শনিক হতেই চেয়েছিলেন। কারণ সক্রেটিস তাঁর শিষ্যকে সব বিষয় প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিলেন। দর্শন নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়, কিন্তু ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না। ধর্ম তাই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে বা তা ধ্বংসপ্রাপ্ত বা বিলীন হয়ে যায়। ঠিক যেমন মিশরের, গ্রীসের, রোমের প্রাচীন ধর্মগুলো বিলীন হয়ে গেছে। সেইসব পূজনীয় দেব দেবীদের আজ আর অস্তিত্ব নেই, এমনকি সামান্য গুরুত্ব নেই। সেইসব দেব দেবীরা এখন গালগল্প বা পুরোকাহিনীর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু প্লাটো আর অ্যারিস্টটল চিন্তা আজও উচ্চজ্ঞানের জগতে আলোচিত হয়। কিন্তু মহামান্য নন তাঁরা। বিশ্ব বা পৃথিবী সম্পর্কে অ্যারিস্টটল মূল্যবান চিন্তাগুলো পরবর্তী জ্যোতির্বিজ্ঞানের জগতে বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। মধ্যযুগে যখন খ্রিস্টান চার্চের নিষেধাজ্ঞার কারণে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা প্রায় আটশো বছরের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, মুসলমানরা বা আরবরা তখন জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা চালিয়ে যান।
মুসলমানদের জ্ঞানচর্চার ভিত্তিটা দাঁড়িয়েছিল প্রায় সম্পূর্ণভাবে প্রাচীন গ্রীসের দর্শন আর বিজ্ঞান চিন্তার উপরে। সেইসঙ্গে প্রাচীন রোম, ইরান আর ভারতীয় কিছু ধ্যান ধারণা নিয়ে। মুসলমানরা ভারত থেকে অঙ্কের ব্যবহারে "শূন্য" এর ধারণা লাভ করেন। পরে তাকে আরো উন্নত স্তরে নিয়ে যান। মুসলমানদের কাছ ইউরোপের গণিতের জগতে শূন্যের ধারণা পৌঁছে যায়। ফলে রোমান অঙ্ক তার অবস্থান হারায়, কেননা সেখানে শূন্য ছিল না। মুসলমানরা চারশো বছর জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতে বিরাট অবদান রাখে। যখন ইউরোপ ছিল চার্চের নিগড়ে বন্দী `অন্ধকার যুগে` মুসলমানরা প্রাচীন গ্রীসের চিন্তাকে বাঁচিয়ে রাখে। নানাভাবে ফ্রাচিন অনেক হারিয়ে গেলেও মানুষের জ্ঞান চর্চা বন্ধ ছিল না। মাঝে মধ্যেই ক্ষমতাবানদের বাধা পাচ্ছিল। কিন্তু জ্ঞানবিজ্ঞান সবসময় তার ধারায় প্রবাহিত হচ্ছিল। মধ্যযুগে আরবদের মাদ্রাসা ছিল তখন জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চার ক্ষেত্রে সব বড় ঘটনা। বড় বড় শিক্ষকদের আবির্ভাব ঘটেছে তখন।
যারা একই সঙ্গে অনেক বিষয়ের উপর বুৎপত্তি অর্জন করছিলেন। অধ্যাপক বলতে তাঁদেরকে বোঝায় যারা নানা বিষয় জ্ঞান রাখেন এবং তা অন্যদের জন্য লিখিতভাবে সংরক্ষণ করে যান। মুসলমানরা পাঁচশো বছর পরে আর তাদের জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার ধারাকে ধরে রাখতে পারলো না। কিন্তু স্বীকার করতে হবে, খ্রিস্টানদের কট্টর ভূমিকার পরিবর্তে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে মুসলমানরা ছিল অনেক উদার। বিজ্ঞানমনস্ক জ্ঞানবিজ্ঞানের সাধনা প্রাচীন গ্রীসের কাছ থেকে চলে যায় মধ্যযুগের আরবদের হাতে, আবার আরব মুসলমানদের কাছ থেকে তা পুনরায় ইউরোপের কাছে। ইউরোপের বিশ্বিদ্যালয়গুলোর গড়ে ওঠার প্রাথমিক অবদান আরবদের। সেই সব নানা ঘটনার ভিতর দিয়ে ইউরোপের আধুনিক যুগের আরম্ভ। চার্চের প্রাধান্য কমতে কমতে প্রায় নাই হয়ে যায়। চার্চের কর্তৃত্ব এখন কিছু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রে চার্চ এখনো অনেক ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের দিকে তাকালে বোঝা যাবে। কিন্তু তার পরেও সেখান জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা চলছে পুরোদমে। চার্চ চাইলেও সবসময় নাক গলাতে পারে না।
ইউরোপের জ্ঞানবিজ্ঞানের শুরুটা প্রাচীন গ্রীসের জ্ঞানবিজ্ঞান এবং আরবদের অবদানকে সঙ্গে নিয়ে। বহু আরবি ভাষার গ্রন্থকে ইউরোপ নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে নিয়েছিল। দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী অ্যারিস্টটলের বিরাট প্রভাব ছিল সেখানে। কিন্তু তিনি পূজনীয় ছিলেন না, সমালোচনার উর্ধ্বে ছিলেন না। কোপার্নিকাস জ্যোতির্বিজ্ঞানের ব্যাপারে অ্যারিস্টটলের চিন্তার সঙ্গে একমত হতে পারেননি। পৃথিবী যে কেন্দ্র নয় এবং সূর্য যে স্থির নয় কোপার্নিকাস তাঁর রচনায় প্রথম সে কথা বললেন। কিন্তু তাতে অ্যারিস্টটলের সম্মান কমলো না বা তাঁর জ্ঞানচর্চার ভিত্তিটা বাতিল হলো। কারণ অ্যারিস্টটলের চিন্তার উপর দাঁড়িয়ে তাঁর চিন্তা করেই প্রশ্ন করে কোপার্নিকাসের চিন্তা এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কোপার্নিকাসের এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পর। কোপার্নিকাসের চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্রুনো সেই কথা বলতে গেলে, সূর্য সম্পর্কে চার্চের বিশ্বাসকে তা আঘাত করে। ফলে ব্রুনোকে চার্চ পুড়িয়ে মেলেছিল।
গ্যালিলিও কোপার্নিকাসের মতবাদ যে সত্য দূরবীন আবিষ্কার করে প্রমাণ করে দিয়েছিল। সেইজন্য পরে চার্চের ক্ষমতার কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয় গ্যালিলিও। কিন্তু মানুষের জ্ঞানচর্চা ইতিহাস বন্ধ থাকে না। কারণ মানুষের মনের প্রশ্নই মানুষকে জ্ঞানচর্চা করতে বাধ্য বা প্রলুব্ধ করে। শিক্ষকের দায়িত্ব এখানেই, মানুষের বা শিক্ষার্থীর এই প্রশ্ন করার জায়গাটা তৈরি করে দেয়া। পাঠদান কক্ষে শিক্ষার্থীর প্রশ্ন করার অধিকারকে শুধু সংরক্ষণ করা নয়, তাকে প্রশ্ন করতে আরো উৎসাহ দেয়া। সেই সঙ্গে প্রশ্ন করার পদ্ধতির সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরিচয় ঘটিয়ে দেয়া। বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের বলতেন, তোমরা আমার সকল কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবে, মনোযোগ দিয়ে শুনে তার মূল বক্তব্যটা আগে অনুধাবন করবে কিন্তু আমার কোনো বক্তব্যই বিনা প্রশ্নে বা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করবে না। বুদ্ধের এই বাণী পরে আর বৌদ্ধধর্মের অন্যরা মেনে চলেননি।
প্রাচীন গ্রীসের মতো প্রাচীন ভারতের শিক্ষায় এই প্রশ্ন করার রীতি ছিল। গ্রীসের সঙ্গে ভারতের বিশেষ একটা পার্থক্য ছিল এই যে, প্রশ্ন করা যাবে কিন্তু বেদের কথার বাইরে যাওয়া যাবে না। চারটি বেদে যা আছে তা সম্পূর্ণ মান্য করে তবেই প্রশ্ন করা চলবে। ফলে বেদের পর পুরাণ উপনিষদ যা কিছু রচিত হয়েছে তা আত্মার চিন্তার বাইরে গিয়ে বস্তজগত নিয়ে আলোচনা করতে পারেনি। চার্বাকরা ধর্মগ্রন্থ বা ঐশ্বরিক গ্রন্থ বলে বেদকে মানতেন না। বস্তুজগত নিয়ে কথা বলতেন আর আত্মার ধারণাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছিলেন। বলেছিলেন, দেহের বাইরে কোনো আত্মা নেই, দেহের সঙ্গে আত্মার মৃত্যু ঘটে। সেজন্য ব্রাহ্মণরা তাঁদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। কিছুদিন পর জৈন ধর্মের প্রবর্তক মহাবীর বেদকে ঐশ্বরিক গ্রন্থ বলে মানলেন না। নতুন অহিংস ধর্মমত প্রচার করলেন। কিন্তু তিনি আত্মার ধারণাকে মেনে নিলেন। পুনর্জন্ম মেনে নিলেন। ফলে তাঁর সঙ্গে ব্রাহ্মণদের বিরোধ হলো না। কারণ বৈদিক বা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মূল বিষয় হলো আত্মা।ৎ
ইসলাম আত্মায় বিশ্বাসের করে কিন্তু বারবার পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে না। মাত্র কেয়ামতের পর হাশরের দিনে মানুষের আর একবার জন্ম হবে। কিন্তু বৈদিক, জৈন আর বৌদ্ধধর্ম আছে পুনর্জন্মের কথা। বারবার পুনর্জন্ম ঘটে। ব্রাহ্মণ্য ধর্মে এবং জৈন ধর্মে প্রশ্ন করার সুযোগ আছে কিন্তু তার সীমাবদ্ধতা এই যে, তা আত্মার বাইরে যেতে পারে না। ভারত সে কারণেই জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায়, রাষ্ট্র সম্পর্কিত ধারণায় তেমন কোনো অবদান রাখতে পারেনি। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র নিয়ে যেসব আলোচনা আছে, লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সেখানে প্রশ্ন নেই। সবটাই নির্দেশ। কঠিন কঠোর বহু নির্দেশ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে উপর থেকে। বলা হয়েছে ধর্মকে ব্যবহার করতে সাধারণ মানুষকে দমিয়ে রাখার জন্য। গুরুর আদেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা হচ্ছে প্রচীন ভারতীয় শিক্ষা। মুখস্থ করা ছাড়া আসলে সেখানে নতুন কিছু শেখার সুযোগ কম। সত্যি বলতে অর্থশাস্ত্রের আলোচনা সে পথেই এগিয়েছে। যা বলা হয়ে গেছে অর্থশাস্ত্রে, তাই পৃথিবীর জন্য শেষ কথা। তার আর কোনো নড়চড় হতে পারে না, ঠিক যেমন মনুর বিধান।
ফলে বিশ্বের বর্তমান রাষ্ট্রচিন্তায় এই অর্থশাস্ত্র নাম উচ্চারিত হওয়া ছাড়া আর কোনো ভূমিকা নেই। বুদ্ধের মৃত্যুর পর বৌদ্ধধর্ম শেষ পর্যন্ত আত্মা আর পুনর্জন্মের ভিতর ঘুরপাক খেতে খেতে বিশ্বকে নিরামিষ খাওয়ানো ছাড়া দর্শন আর বিজ্ঞানের জগতে কিছু দিয়ে যেতে পারেনি। কিন্তু ঈশ্বরের বন্ধন থেকে মানুষকে কিছুটা মুক্ত করেছে। পরবর্তীকালে বুদ্ধ নিজেই আবার সেখানে ঈশ্বর হয়ে উঠেছেন, ভগবান বুদ্ধ হিসেবে তাঁর স্বীকৃতি মিলেছে বৈদিকদের কাছেও। বিশ্বে বৌদ্ধধর্মের বড় অবদান স্থাপত্য আর ভাস্কর্য বিদ্যায়। ইউরোপ সেক্ষেত্রে দ্বাদশ শতক থেকে অন্ধকার যুগকে পার করে এসে সক্রেটিসের প্রশ্ন করার শিক্ষার ভিতর দিয়ে পুরানো সকল ধ্যানধারণার বিপরীতে সম্পূর্ণ নতুন ধ্যারণাকে জায়গা দিতে পেরেছে। বিজ্ঞানের জগতে তার অবদান তাই আজ প্রশ্নাতীত। খুব দ্রুত তাকে কেউ ছাড়িয়ে যেতে পারবে বলে মনে হয় না। সারাবিশ্বের উপর নানা রকম শোষণ নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর রক্তাক্ত যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে ইউরোপ বিজ্ঞানের জগতে এমন সব অবদান রেখেছে যার উপর সারা বিশ্ব এখন দাঁড়িয়ে আছে।
এই ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে সাধারণ কারিগর আর নানা পেশার শিক্ষক আর বিজ্ঞানীরা। বহু শিক্ষক সেখানে একদা সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য চার্চের হাতে প্রাণ দিয়েছেন। ধর্ম থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে। বহু শিক্ষক সত্য উচ্চারণের ভিতর দিয়ে ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত বহু ব্যক্তি এবং ঘটনার চরিত্র নতুনভাবে পাল্টে দিয়েছেন। বহু নায়ককে খলনায়ক বানিয়েছেন। বহু বীরকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। ইতিহাসের শিক্ষক হাওয়ার্ড জিন আমেরিকার আবিষ্কারক হিসেবে পরিচিত পূজনীয় কলম্বাসের চরিত্রকে নতুনভাবে প্রকাশ করলেন একজন খুনী এবং লুণ্ঠনকারী দস্যু হিসেবে। কলম্বাস সম্পর্কে মানুষের চারশো বছরের ধারণাকে পাল্টে দিলেন। সত্যিকারের শিক্ষক হলেন তাঁরাই।
কথা হলো একজন শিক্ষক কী শেখাবেন সেটা বলার আগে প্রশ্ন তিনি নিজে কতোটা জানেন। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে, তার জ্ঞানের পরিধি অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখে। শিক্ষক কী পড়াবেন সেটা বিবেচনা করার আগে এই চলমান বিশ্বের ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, শিল্প সাহিত্য সহ প্রকৃতিক জ্ঞানবিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর কতটা ধারণা আছে সেটাও প্রধান আলোচ্য। সাহিত্য পড়াতে গেলে ইতিহাস এবং সমাজবিজ্ঞানের উপর ধারণা থাকতে হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়াতে গেলে দর্শনের বিবর্তন এবং ইতিহাসের উপর দখল থাকতে হয়। শিক্ষকের যদি নিজের জ্ঞানের জগত খুব সীমাবদ্ধতা থাকে বা সামান্য ধারণা না থাকে, তাহলে তিনি কেমন ভাবে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করার স্বাধীনতা দেবেন? বা তাদের প্রশ্নেরই বা কী জবাব দেবেন? সেই প্রশ্নে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার শিক্ষকদের শিক্ষার মান কোন পর্যায়ে আছে গত শিক্ষক দিবসে কেউ কি সেই প্রশ্ন তুলেছেন।
জ্ঞানের প্রশ্ন বাদ দিলেও যে দেশে শিক্ষকরা প্রায় সবাই চাটুকারিতায় লিপ্ত, মাথা উঁচু করে সত্য বলার সাহস রাখে না, সুবিধা নেবার জন্য রাতকে দিন করার মতো মিথ্যা বলতে রাজি আছে; শিক্ষার্থীদেরকে তারা কী মহান শিক্ষা দান করবেন। তাঁরা কি আদৌ শিক্ষক নামের যোগ্য? কিন্তু কিছু থেকেই যাবেন যাঁরা জ্ঞানের জগতকে বিকশিত করার দায়িত্ব নিজের মতো করে পালন করে যাবেন।
লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ