মৎস্যবিজ্ঞানী হীরালাল চৌধুরীর আজ জন্মদিন
ছাড়পত্র ডেস্কপ্রকাশিত : নভেম্বর ২১, ২০২৩
কার্প জাতীয় মাছের প্রণোদিত প্রজননের জনক খ্যাতনামা মৎস্যবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. হীরালাল চৌধুরীর আজ জন্মদিন। ১৯২১ সালের ২১ নভেম্বর সিলেটের (তৎকালীন শ্রীহট্টের) সুরমা ভ্যালি সংলগ্ন কুবাজপুর গ্রামে তার জন্ম। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ ই সেপ্টেম্বর কলকাতায় ৯৩ বৎসর বয়সে তিনি মারা যান।
অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন হীরালাল। চারটি বিষয়ে লেটার নিয়ে সিলেটের গোমস্ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন ১৯৩৭ সালে। মেধাবী ছাত্র হওয়ায় কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজের অধ্যক্ষের মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তিতে আই.এসসিতে ভর্তি হন। ১৯৪১ সালে অনার্সসহ বিএসসিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অন্তর্গত বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজ থেকে প্রাণিবিদ্যায় এমএসসি পাশ করেন ১৯৪৩ সালে।
এমএসসি পাশের পর সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজে জীববিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে জন্মভূমি পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর পাঁচ সহকর্মীর সাথে কাজ হারান। চলে যান ভারতে। ব্যারাকপুরে কাছে মণিরামপুর সেন্ট্রাল ফিসারিজ স্টেশনে বর্তমানে ইনস্টিটিউশনে ১ জুন ১৯৪৮ সালে কনিষ্ঠ গবেষণা সহকারী হিসাবে যোগ দেন। ১৯৭৬ সালে অধিকর্তা হিসেবে অবসরের আগপর্যন্ত বিভিন্ন পদে থেকেছেন।
কটকের অণুগুলে জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহকারী (১৯৫০-৫৫), ফিশারি সম্প্রসারণ আধিকারিক (১৯৫৯-৬০), বৈজ্ঞানিক আধিকারিকসহ (১৯৬০-৬৩) মৎস্য গবেষণা প্রধান হিসাবে কর্মরত ছিলেন। কর্মক্ষেত্রে থেকে প্রবন্ধন ও গবেষণালব্ধ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে ফিশারি পরিচালনে দক্ষতাস্বরূপ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অলাবামাস্থিত অবার্ণ বিশ্ববিদ্যালয় হতে এমএস ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
তার গবেষণার বিষয় ছিল মৎস্য প্রজননে পিটুইটারি ইনজেকশনের প্রভাব। ২০১০ সালে সেন্ট্রাল ফিশারিজ ইনস্টিটিউট (বিশ্ববিদ্যালয়ের সমতুল্য) ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করে। ব্যারাকপুরের কেন্দ্রে থাকার সময় তিনি লক্ষ্য করেন, গঙ্গার ধারে ইটভাটায় জোয়ারের জলে ভেসে আসা পেটফোলা মাছ ধরে টিপে দিতেই ডিম্বাকৃতি স্বচ্ছ ডিম বেরিয়ে আসছে এবং কয়েক ঘণ্টা এক পাত্রে রাখার পর জীবনের সঞ্চার প্রত্যক্ষ হচ্ছে।
এটি হীরালালকে প্রণোদিত প্রজনন প্রক্রিয়া সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনার দিকে আকৃষ্ট করে। কটকের মৎস্য গবেষণাগারে সিনিয়ার রিসার্চ অ্যাসিস্টান্ট হিসাবে মাছের এন্ডোক্রাইনোলজি ও ফিজিওলজির উপর দীর্ঘ নয় বৎসর গবেষণা করার পর ১৯৫৭ সালের ১০ জুলাই কার্প প্রজাতির মাছের প্রণোদিত প্রজনন পদ্ধতিতে সাফল্য লাভ করেন যা প্রাণিবিজ্ঞানে প্রথম সারির মৌলিক কাজ হিসেবে পরিগণিত। এর আগপর্যন্ত বিশ্বের কোথাও এই প্রক্রিয়ায় মৎস্য প্রজনন সম্ভব হয়নি।
আজ যেমন রুই, কাতলা, মৃগেল, বাটাখয়র ও গ্রাসকাপ প্রজাতির মাছের প্রজনন সম্ভব হয়েছে, তেমনই কই, পাবদা ও মাগুরসহ বহু মাছের প্রণোদিত প্রজননও করা সম্ভব হয়েছে। তার এই গবেষণার ফলস্বরূপ আজকে মাছচাষি একসঙ্গে সমবয়সী সুস্থ ডিমপোনা তার প্রয়োজনমতো যে কোনো সময়ে চাষের জন্য পেয়ে যাচ্ছে। জাপানের খ্যাতনামা মৎস্যবিজ্ঞানী ডা. কে. কুরোনুমা হীরালালকে ‘প্রণোদিত প্রজননের জনক’ বলে অভিহিত করেন।
হীরালাল কেবল প্রণোদিত প্রজননেরই জনক নন, পরবর্তীতে তিনি পুকুরে মৎস্যোৎপাদন বৃদ্ধিতে নিবিড় মিশ্রচাষের (মিশ্রচাষ হলো একই পুকুরে বিভিন্ন প্রজাতির পৃথক পৃথক জলস্তরে পৃথক পৃথক খাদ্যাভ্যাসে থাকা মাছের বহুগুণ উৎপাদন বৃদ্ধির প্রক্রিয়া) দিশা প্রদর্শক।
এছাড়া তিনি কার্প প্রজাতির বারো রকমের নতুন শঙ্করীকরণ, আঁতুড় পুকুরের ডিমপোনা কোন কোন পোকার দ্বারা আক্রান্ত ও তার প্রতিকার এবং বিজ্ঞানসম্মত ভাবে আঁতুড় পুকুর পালনের পদ্ধতির উপায় বিশদে দেখান। ১৯৭৬ সালে অবসর নেয়ার পর জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার উপদেষ্টা হয়ে সুদান, নাইজেরিয়া, ফিজি, লাওস, ফিলিপাইন, মিয়ানমারসহ বহু বিশ্বের দেশে কাজ করেন।
তিন দশকের অভিন্নতা ও প্রযুক্তিগত বুদ্ধিমত্তা মৎস্য উৎপাদনে ও জলজ পালন বিষয়ে সম্যক জ্ঞান সে দেশের মানুষদের সামনে পরিস্ফুট করেন। হীরালাল চৌধুরী ফিলিপিনসে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফিশারিজ উন্নয়ন কেন্দ্রের বা এসইএফডিইসি-র আঞ্চলিক সমন্বয়কারী ও সহকারী অধিকর্তা (১৯৭৬-৭৯), ফিলিপাইনের এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাকোয়াকালচারের পরিদর্শক বিজ্ঞানী (১৯৮৫-৮৮) ছিলেন।
হীরালাল চৌধুরী ভারতে “প্রণোদিত প্রজননের জনক” হিসাবে আখ্যা লাভ ছাড়াও দেশে-বিদেশের বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৬০ সালে অর্জন করেন চন্দ্রকলা হোরাস্মৃতি স্বর্ণপদক, রফি আহমেদ কিদওয়াই পুরস্কার, গামা-সিগমা-ডেল্টা পুরস্কার, আমেরিকার অবার্ণ বিশ্ববিদ্যালয় হতে গোল্ডেন কী পুরস্কার, বিশ্ব জলজ চাষ পুরস্কার (১৯৯৪) এবং এশিয়াটিক সোসাইটি পুরস্কার (৬ মে, ২০০২)।
ভারত সরকার তার যুগান্তকামী ‘প্রণোদিত প্রজনন পদ্ধতি’ উদ্ভাবনের দিনটি স্মরণে রেখে ১০ জুলাইকে ‘জাতীয় মৎস্যচাষী দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করে। ১৯৯৮ সালে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় তার মৎস্যবিজ্ঞানে সারাজীবনের অবদান ও সেবার জন্য সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে।