কবি মুস্তফা আনোয়ার

কবি মুস্তফা আনোয়ার

নিভৃতচারী শব্দসৈনিক ও কবি মুস্তফা আনোয়ার

মুস্তাফা মহিউদ্দীন

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৩, ২০২৪

বৈশাখের রুদ্রজামা আমায় পরিয়ে দে মা
আমি এবার যুদ্ধে যাব...

কবিতায় একথাগুলো উচ্চারণ করেছিলেন ষাটের দশকের অন্যতম কবি মুস্তফা আনোয়ার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময়। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক কবি, চিন্তায় ও মননে। চাকরি করতেন রেডিওতে। একাত্তরের পঁচিশে মার্চের রাতে পাকসেনাদের ভয়াবহ কর‌্যাকডাউনের পরপর যে তিনজন অকুতোভয় রেডিও কর্মকর্তা জীবনবাজি রেখে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র চালু করেছিল, মুস্তফা ছিলেন তাদের অন্যতম। অন্য দুজন ছিলেন বেলাল মোহাম্মদ ও আবুল কাশেম স্বন্দীপ। এই শব্দসৈনিক ও কবির মৃত্যুদিনটি চলে গেল ৬ এপ্রিল। ৬৬ বছর বয়সে ২০০৬ সালের ৬ এপ্রিল ফুসফুস ক্যান্সারে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুদিনে তাকে স্মরণ করা হয়নি কোনো অনুষ্ঠানে। পত্রিকায় কোনো সংবাদ চোখে পড়েনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ এদেশে কেউ তাকে মনে রাখিনি আমরা। তার অবদানের কোনো সামাজিক স্বীকৃতিও আমার জানা মতে মেলেনি।

মুস্তফা আনোয়ারকে আমি প্রথম দেখি শাহবাগের রেখায়নে সম্ভবত ১৯৭৩ কী ১৯৭৪ সালে এক বিকেলবেলা। পাশে ছিল প্রয়াত কবি আবিদ আজাদ। আবিদ পরিচয় করিয়ে দিলো, এই হচ্ছে কবি মুস্তফা আনোয়ার। রেডিওতে অনুষ্ঠান প্রযোজক। আমি চেয়ে দেখলাম ফর্সা টকটকে ভরাট মুখ। ভারি গুম্ফরেখা দু’পাশে কিছুটা ঝোলানো। কালো-লালচে মিশেলে ঘন কোঁকড়া চুল, ব্যাকব্রাশ করা, প্রায় কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। কিছুক্ষণ আলাপের পর মনে হলো, তিনি স্বল্পভাষী ও অন্তর্মুখী চরিত্রের। তার তখন মাত্র একটি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে ‘কোথাও কোনো ডাকঘর নেই’ এই শিরোনামে।

সেই সময় রেডিওতে যারা চাকরি নিতেন, তারা সবাই কমবেশি সৃজনশীল ছিলেন। কবি শামসুর রাহমান প্রথম দিকে রেডিওতে চাকরি নিয়েছিলেন। মুস্তফা ভাই রেডিওতে বেশ কিছু চমৎকার অনুষ্ঠান নির্মাণ করেছিলেন। তার হাত দিয়েই একসময়ের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান `উত্তরণ` ও এধরণের আরও কিছু মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান নির্মিত হয়েছিল। রেডিও নাটক প্রযোজনায়ও তিনি ছিলেন সাহিত্যনির্ভর ও রুচিশীল। কবি আবিদ আজাদকে দিয়ে তিনি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অনেক বিখ্যাত গল্পের বেতার নাট্যরূপ করিয়েছিলেন, যা শ্রোতানন্দিত হয়েছিল। এছাড়া আবিদের কিছু বিখ্যাত কাব্যনাট্য যেমন বনতরুদের মর্ম, সকাল, সুন্দর— এগুলো তারই প্রযোজনায় নির্মিত।

ক্যাম্পাসেও শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে মাঝেমাঝে আসতেন মুস্তাফা ভাই বিকেলে রেডিও থেকে। খুব আড্ডাবাজ ছিলেন না, তবে আড্ডাসঙ্গী। আবিদ থাকতো অথবা মান্নান সৈয়দ, তার দুজন ঘনিষ্ঠ সঙ্গী। শাহবাগের রেখায়ন আড্ডায় এলেও একটু চুপচাপই থাকতেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তার ছিল অন্যরকম সম্মান আমাদের চোখে। এত মৃদুভাষী কিন্তু আড্ডার নীরব শ্রোতা। কবিতার ঘোরেই বোধহয় থাকতেন বেশিরভাগ সময়। পরবর্তীতে প্রকাশিত তার অসাধারণ গল্পগ্রন্থ `ক্ষুর` বিদগ্ধমহলে ছিল বহুল প্রশংসিত। একেবারে ভিন্নধরনের লেখা। বিশিষ্ট লেখক ও অধ্যাপক আবু রুশদ মতিনউদ্দিন চমৎকার রিভিউ করেছিলেন গল্পগ্রন্থটির এক ইংরেজি পত্রিকায় মনে আছে। কবিতায়ও তিনি ছিলেন ভিন্ন স্বরের প্রবর্তক। তার `তুঁত` কাব্যগ্রন্থে তিনি পরাবাস্তব জগতের রহস্য উন্মোচনে ব্রতী হয়েছিলেন।

এই কবির সঙ্গে আমার ছাত্রজীবনে তেমন সখ্য গড়ে ওঠেনি, যদিও আবিদ সবসময় তার ভূয়সী প্রশংসা করতো আর বলতো, এই নিভৃতচারী বিশুদ্ধ কবি কোনো প্রচার-প্রচারণার ধার ধারেন না। কবিতার চাষ তিনি করে যাবেন আপন মগ্নতায়। মুস্তফা ভাইয়ের সঙ্গে আমার সখ্য বেড়ে যায় চাকরি জীবনে। সম্ভবত ১৯৯৪ কী ১৯৯৫ সালে আমি তখন রাজশাহীতে কর্মরত, রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক (এডিশনাল সিসিএম) হিসেবে। পদ্মার পাড়ে আমার কোয়ার্টার। মুস্তফা ভাই এলেন রাজশাহীতে বেতারের উপ আঞ্চলিক পরিচালক হয়ে। আবিদের কাছ থেকে আমার ফোন নাম্বার নিয়ে এসেছেন। হঠাৎই তার ফোন পেলাম। জানালেন যে, উঠেছেন রেডিও ট্র‍্যান্সমিশন হাউসের রেস্ট হাউসে, একা। আমার সঙ্গে যোগাযোগের পর আমরা নিত্যদিনের বৈকালিক আড্ডার সঙ্গী হয়ে গেলাম। চষে বেড়িয়েছি পুরো রাজশাহী শহর— নিউমার্কেট, সাহেববাজার, অলকা সিনেমা হলের মোড়ে ফ্রেশ চপ আর চায়ের নেশায়।

আমি যখন রাজশাহীতে সেসময় আমার দুবন্ধু ফিরোজ ও আসাদ, রাজশাহীতে নিজেদের কর্মক্ষেত্রে যোগ দেয়। কলেজজীবনের বন্ধু ফিরোজ (ফিরোজ আহমেদ, সাবেক সচিব) এবং বিশ্ববিদ্যালয়-বন্ধু আসাদ, (আসাদুজ্জামান, সাবেক ইডি, বাংলাদেশ ব্যাংক)। ফিরোজ রাজশাহীতে অতিরিক্ত কাস্টমস কমিশনার ও আসাদ বাংলাদেশ ব্যাংকের জিএম হিসেবে। দুজনেরই পরিবার থাকে ঢাকায়, শুধু আমিই পরিবার নিয়ে থাকি রাজশাহীতে। আমার বাসা হয়ে গেল তাদের সন্ধ্যার আড্ডাকেন্দ্র। রাতে প্রায়ই তাদের নৈশ আহার হয় আমার বাসায়। আমার আর মুস্তফা আনোয়ারের সঙ্গে বৈকালিক ঘুরাঘুরিতে তারাও শামিল হয়। তবে অধিকাংশ দিন আমরা দুজনেই আড্ডা দিতাম বেশি। আমরা চারজন ছুটির দিনগুলোতে জীপে বেরিয়ে পড়তাম গোদাগাড়ী না হয় নাচোল। কখনো চলে যেতাম চাঁপাইনবাবগঞ্জ। মনে আছে, নাচোলে এক টুকরো মাটি তুলে কপালে ঠেকিয়ে মুস্তফা ভাই বললেন, প্রণাম তোমাকে হে ইলা মিত্রের নাচোল! গোদাগাড়ীতে পথের পাশের চা-দোকানে বাঁশের মাচায় বসে মহিষের ঘন দুধে বানানো চা খেতে খেতে গল্পে মেতে উঠেছি আমরা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ যেয়ে বর্ডার স্টেশনে কোনো সাধারণ দোকানে বসে অসাধারণ পরোটা- মাংস খেয়েছি। ঘুরে দেখেছি আমবাগানগুলো, ফ্রেশ আম পেড়ে ঝুড়িভর্তি আম কিনেছি। কখনো চলে গেছি চারঘাট আম উৎসব আনন্দে। ওখানকার নিবাসী তরুণ কবি মোস্তাক রহমানের আতিথেয়তা মুগ্ধ করেছে।

রাজশাহী শহরের নিউমার্কেটের দোতলায়, অথবা সোনাদীঘির মোড়ে বায়েজিদ রেস্তোরায় আমি আর মুস্তফা ভাই প্রায়ই আড্ডা দিতাম। সঙ্গে মাঝে মাঝে থাকতো কবি মোস্তাক রহমান, মঞ্জুর রহমান বাবু (প্রয়াত), জামাল দ্বীন সুমন। শার্প চেহারার মোস্তাক কবি হিসেবে মেধাবী ও সুধীন দত্তের একনিষ্ঠ ভক্ত। মুস্তফা ভাইকে পেয়ে তার কাব্য জিজ্ঞাসার যেন অনেক উত্তর পেয়ে গেল। প্রায়ই তারা কবিতার জটিল বিষয়-আসয় নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনায় মগ্ন হতো। রাজশাহীতে আমাদের এসব শখের ভ্রমণ আর আড্ডাবাজির গল্প শুনে বন্ধুকবি আবিদ আজাদ বলতো, আমি যাব রাজশাহী, শীতটা একটু কমুক। হাঁপানির টানের জন্য শীত-এলাকায় যেতে ভয় পাই। আমি কৌতুক করে বলতাম, তুমি তো রাজশাহী নিয়ে যে কবিতা লিখেছো, রাজশাহীবাসী তোমাকে অনেকদিন মনে রাখবে।

মন বলছে, রাজশাহী যাই, রাজশাহী যাই,
রাজশাহী কি ইংরেজিতে অনার্স পড়ে?

আবিদ প্রশংসায় লজ্জা পেলে একটা বিশেষ ভঙ্গিতে হাসতো, সেই হাসি দিয়ে বলেছিল তার প্রথম রাজশাহী ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আর অই কবিতা লেখার নেপথ্য গল্প। মুস্তফা ভাই স্বল্পভাষী। এরকম লোকের সঙ্গে আড্ডা সাধারণত জমে ওঠে না। কিন্তু গভীর শিল্পবোধ আর কবিতাপ্রেম এই মানুষটির ভেতর এতটাই প্রবল যে, এবিষয়ে আলাপে তিনি অনর্গল কথা বলে যেতেন। ইয়োরোপীয় সাহিত্য বিষয়ে তার ছিল অগাধ পড়াশোনা। ছিলেন কাফকা, কাম্যু ও র‍্যাঁবোর ভক্ত। মাঝেমাঝে আমার মনে হতো, তিনি কাফকার বিবরে বাস করতেন। এনিয়ে তার সাথে মাঝেমধ্যে রসিকতাও করতাম। পরবাসে বসবাস নামে তার একটি চমৎকার বিদেশি কবিতার অনুবাদগ্রন্থ আছে। কবিতার ঘোরেই থাকতেন মুস্তফা আনোয়ার। নিম্নবর্গের মানুষের জীবন-যাপন গভীর বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে দেখতেন তিনি। তাদের মদ্যপান দেখতে ছুটে যেতেন মেথরপট্টী। পুরানো ঢাকার নিম্নবিত্তের মানুষগুলোর জীবনযাপন প্রত্যক্ষ করা ছিল তার একটি নেশা। তার কবিতার ভাষায়, ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে আমি যাই।

পুরানা ঢাকায় তাই যেতেন মুস্তফা আনোয়ার। নিজেকে তিনি কল্পনা করেছেন `বুড়ো হাবড়া তুঁত’ গাছের সঙ্গে। তুঁতের পাতা থেঁৎলে তার কষ পান করে ডোম-মেথরদের সঙ্গে শীর্ণ গলির ড্রেনে পড়ে থাকতে চেয়েছেন। নিজেকে ধ্বংস করে নেশাগ্রস্থ মাতাল জীবনের তিক্ততা, দুঃখবোধ, পরাজয়ের গ্লানি অনুভব করতে চেয়েছেন কবিতায়। তার `তুঁত` কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করলে একেবারে অন্য এক মুস্তফা আনোয়ারের সঙ্গে পাঠক পরিচিত হবেন, এ আমার স্থির বিশ্বাস। দুর্ভাগ্য আমাদের, এরকম দেশপ্রেমিক, আত্মত্যাগী মুক্তিযোদ্ধা শব্দসৈনিক ও নির্ভেজাল, শুদ্ধ কবিকে আমরা তার জীবদ্দশায় সামান্যতম মূল্যায়ন করিনি।

তুঁত কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না:

না

আমরা মাতৃভাষা বলি,
কেউ কাউকে বুঝি না।
আমরা একঘরে থাকি
খাট টুকরো।

চাঁদ টুকরো হোক, কী আসে?
নদী টুকরো হোক, কী আসে?
ভালোবাসা টুকরো টুকরো হোক—
পচা-চিঠি ডাকবাক্সে পাবে না।

রাজশাহীতে থাকাকালীন একবার মুস্তফা ভাই প্রস্তাব দিলেন, মহিউদ্দীন, চলো পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার, মহাস্থানগড় ঘুরে আসি। তোমার সঙ্গে ট্রেনে যাব। অনেকদিন যাব যাব করেও এই জায়গা দুটিতে আমার যাওয়া হয়নি। বললাম, তাই হবে, মুস্তফা ভাই। খোঁজ নিয়ে দেখি ভালো কোনো রেস্ট হাউজের সন্ধান পাই কীনা।

একদিন গিন্নীকে একথা বলতে সে প্রস্তাব দিল, তুমিতো অফিসিয়ালি সেলুন পাও। উনাকে নিয়ে সেলুনে যেতে পারো। বেড়ানো হবে, আবার থাকার ব্যবস্থাও হবে। আমি বললাম, চমৎকার আইডিয়া! মুস্তফা ভাইয়ের সঙ্গে দিনক্ষণ আলাপ করে জয়পুরহাট ও বগুড়া স্টেশন পরিদর্শনের একটা অফিসিয়াল ট্যুর প্রোগ্রাম করলাম। তারপর নির্ধারিত দিনে মুস্তফা ভাইসহ বেরিয়ে পড়লাম লোকাল ট্রেনে নন-এসি সেলুন লাগিয়ে জয়পুরহাটের উদ্দেশে। নিয়মমতো উনার জন্য একটি প্রথম শ্রেণির টিকেট কেটে নিলাম। কেননা প্রাধিকারমতে সেলুন শুধু আমার বা আমার পরিবারের প্রাপ্য। মুস্তফা ভাই খুব এনজয় করেছিলেন সেলুন-ভ্রমণ। গভীর রাতে পার্বতীপুরগামী ট্রেনটি জয়পুরহাট পৌঁছালে স্টেশন কর্তৃপক্ষ সেলুনটি কেটে জয়পুরহাট স্টেশন ইয়ার্ডে একটি সেলুন সাইডিংয়ে রাখলো। আমরা তখন ঘুমে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, প্রবল বৃষ্টি। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হতেই সেলুন-বেয়ারার গরম চা নিয়ে এলো রুমে। মুস্তফা ভাই সোফায় হেলান দিয়ে চা খেতে খেতে জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখে বললেন, বাহ, মনে হচ্ছে সমুদ্রের জাহাজে বসে চা খাচ্ছি। চারিদিকে অবিশ্রান্ত জল ঝরছে আর ছোট্ট একটা জাহাজের মতো লৌহপাতের ওপর স্থির দাঁড়িয়ে আমাদের নিজস্ব ঘর।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বৃষ্টি থেমে গেল। গোসল-টোসল সেরে নাস্তা খেয়ে আমি নেমে গেলাম স্টেশন পরিদর্শনে। মুস্তফা ভাই রয়ে গেলেন সেলুনে, বই পড়ে সময় কাটাবেন। কাজ সেরে দুপুরে সেলুনে দুজনে একসঙ্গে মাছভাত-ডাল খেলাম। সেলুন-বেয়ারার-কাম-বাবুর্চি শহর আলীর ডাল রান্না অপূর্ব হয়। খেয়ে-দেয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়লাম পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার। অনেক ছবি তোলা হলো মুস্তফা ভাইয়ের সঙ্গে। তখন তো আর এরকম মোবাইল ফোন ছিল না। মুস্তফা ভাই একটা পুরোনো ক্যামেরা সঙ্গে নিয়েছিলেন। ফিরে এলাম প্রায় সন্ধ্যায়। একটু পর এলো জয়পুরহাটে তৎকালীন ডিসি/ফুড ও কবি তৌহিদ আহমেদ। তিনজনে সেলুনে বসে জম্পেশ কাব্য-আড্ডা হলো। রাতে তৌহিদসহ তিনজনে রাতের খাবার খেলাম। তৌহিদ চলে গেল। পরদিন আমরা যাব বগুড়া। ট্রেন যাবে শান্তাহার। ব্রডগেজ সেলুন, বগুড়া মিটারগেজ, তাই যাওয়া যাবে না ট্রেনে। ট্রেনে গেলাম শান্তাহার। সেখানে সেলুন-সাইডিয়ে সেলুন রেখে আমরা বেরিয়ে পড়ি সড়কপথে বগুড়া। মহাস্থানগড় ঘুরে-টুরে, ফেরার পথে বগুড়ার আকবরিয়া হোটেলে খেয়ে আমরা ফিরে আসি শান্তাহার, সেলুনে রাত্রিযাপনের জন্য। পরদিন রাজশাহীগামী এক লোকাল ট্রেনে সেলুন লাগিয়ে শুরু হয় আমাদের রাজশাহী যাত্রা। সারাপথ চলে আমাদের আড্ডা আর সঙ্গে চা-কফি। ব্ল্যাক কফি মুস্তফা ভাইয়ের খুব প্রিয়, তিনি সঙ্গে কফির কৌটো নিয়ে গিয়েছিলেন।

আমার কাছে মনে হলো, মহাস্থানগড় ও পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার দেখার চেয়ে ভিড়-বাট্টার লোকাল ট্রেনে সেলুনে শুয়ে-বসে-খেয়ে রাত্রিদিন ভ্রমণই মুস্তফা ভাইয়ের কাছে ছিল আনন্দদায়ক ঘটনা। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, `মহিউদ্দীন, আমি কল্পনাও করিনি এরকম চমকপ্রদ সেলুন-ভ্রমণ ভাগ্য আমার কোনোকালে হবে। শুধু দূর থেকে ছেলেবেলায় যশোর স্টেশনে মন্ত্রী-মিনিস্টারদের ভিআইপি সেলুন দেখেছি ট্রেনে লাগতে।` স্বল্পভাষী এই কবির মুখের পরিতৃপ্তির হাসি এখনও স্পষ্ট মনে আছে আমার। মনের দিক থেকে মুস্তফা ভাই আমার কাছের মানুষ ছিলেন, যদিও সবসময় তা প্রকাশ করিনি। তাকে শুধু বলেছিলাম, `আপনার ভাগ্যেতো এই অভিজ্ঞতাও আছে যে, দেশের ওপর হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়া পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর আক্রমণের তিনদিনের মাথায় চট্টগ্রাম বেতারের ট্র‍্যান্সফরমার চুরি করে কালুরঘাটে বেতারকেন্দ্র চালু করেছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সূতিকাগারতো ওটাই। এরকম সাহসী জীবনবাজি পদক্ষেপ ক’জন নিতে পারে? আবার এই আপনিই তো বিজয়ীর বেশে ১৬ ডিসেম্বরের পর কার্গো বিমানে চড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কলকাতা থেকে তেঁজগাও বিমানবন্দরে অবতরণ করেছিলেন। বিমান থেকে নেমেই দেশের মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদেছিলেন বলে জানিয়েছিলেন। এরকম অভূতপূর্ব অর্জনের সৌভাগ্য কজনের হয়, মুস্তফা ভাই? আপনি অনেক ভাগ্যবান। নিজের জীবনে কারুর কাছ থেকে কিছুই নেননি, শুধুই দিয়েছেন দেশমাতৃকাকে, পরিবারকে, বাংলা কবিতাকে।

রাজশাহীতে, যা ওল্ড নাটোর রোড নামে পরিচিত, একটি বইয়ের দোকান ছিল। জানি না এখনও আছে কীনা। জায়গাটা নিরিবিলি আর দোকানটির সংগ্রহ ছিল চমৎকার। কলকাতার সানন্দা-দেশ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত সব লেখকদের সর্বশেষ গ্রন্থও পাওয়া যেত দোকানটিতে। মালিক ছিলেন অকৃতদার এক হিন্দু বৃদ্ধ ভদ্রলোক। নাম ভুলে গেছি। আমরা আড়ালে বলতাম, হিন্দু কাকার দোকান। মুস্তফা ভাই থাকতেন যে রেস্ট হাউজে, সেটার লোকেশন কাঁটাখালী, শহর থেকে একটু বাইরে ভার্সিটির দিকে। আমি থাকি আরেক প্রান্তে পদ্মার পাড়ে। ফলে আমাদের দুজনের জন্য মাঝামাঝি এই হিন্দুকাকার বইয়ের দোকানটি ছিল দেখা-সাক্ষাৎ ও আড্ডার জন্য সুবিধাজনক। তো, একদিন মুস্তফা ভাইয়ের জন্য নির্ধারিত সময়ে ওই দোকানে গেছি। দেখা হয়ে গেল সেখানে তরুণ কবি মোস্তাক রহমানের সাথে। সেও ওখানে ঢুঁ মারে নতুন বইয়ের সন্ধানে। বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে সময়ক্ষেপণ করছি মুস্তফা ভাইয়ের জন্য। মোস্তাককে বললাম, কবি মুস্তফা আনোয়ারকে চেনেন? উত্তরে ও জানালো, না তো। কে তিনি? আমি বললাম, পটুয়া কামরুল হাসানের আঁকা পশুরূপী কুখ্যাত ইয়াহিয়ার সেই বিখ্যাত পোস্টারটি দেখেছেন? মোস্তাক বললো, দেখেছি। আমি বললাম, পোস্টারের নিচে যে ক্যাপশনটি ছিল, এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে, এই শ্লোগানটি ছিল মুস্তফা আনোয়ারের লেখা।  আরও বললাম, আপনার হয়তো মনে নেই, তখন আপনারা অনেক ছোট, আমার স্পষ্ট মনে আছে, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে একটা ফিলার প্রায়ই প্রচারিত হতো: `ইয়াহিয়া নরপশু, এরা মানুষ হত্যা করছে, আসুন আমরা পশু হত্যা করি।` এটিও তার লেখা। গল্পচ্ছলে একদিন কথাগুলো আমাকে বলেছিলেন মুস্তফা ভাই। আমার কথা শুনে মোস্তাকের চোখে-মুখে ভালোলাগামিশ্রিত বিস্ময়!

বললাম, অপেক্ষা করেন, একটু পরেই উনি এখানে আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে মুস্তফা ভাই এসে হাজির। মোস্তাকের সঙ্গে পরিচয়পর্ব শেষে শুরু হোলো আমাদের আড্ডা চায়ের ফাঁকেফাঁকে। দোকানের মালিক, আমাদের সেই হিন্দু কাকা, নিজেই চায়ের অর্ডার দিলেন। দিতেনও প্রায়ই। আমরা ছিলাম উনার বাঁধা কাস্টমার। রাজশাহীতে মুস্তফা ভাই বেশ কিছু নতুন কবিতা লিখেছিলেন। সেসব তিনি আড্ডায় আমাদের পড়ে শোনাতেন। আমরাও অনেক সময় পীড়াপীড়ি করতাম শোনার জন্য। তিনিও মতামত চাইতেন। অনেকসময় রসিকতা করে বলতেন, বুঝলা, রাজশাহীতে বদলী একটা উপকার আমার করেছে, কলম দেখি আবার সচল হচ্ছে! আমি বললাম, তাইলে তো রাজশাহী আপনার জন্য লক্ষ্মীমন্ত শহর, মুস্তফা ভাই। তা বলতে পারো, দীর্ঘ গোঁফের ফাঁকে স্মিত হেসে উত্তর দিলেন মুস্তফা ভাই। তিনি বললেন, বুঝলা মহিউদ্দীন, কবিতা চর্চায় একবার বিরতি আসলো তো, মরেছো। বন্ধ্যাত্ব সহজে কাটে না। Poetry is a coquettish harlot অনেকটা ছেনাল মাগীর মতো, সারাক্ষণ লেপ্টালেপ্টি, জাপ্টাজাপ্টি কইরা থাকতে পছন্দ করে। তা না করছো তো তোমারে ছাইড়া যাইবো গা! গাঢ় কবিতা-আড্ডায় এরকমই প্রাণবন্ত অকপট উক্তি করতেন মুস্তফা ভাই। রাজশাহী থাকাকালীন রচিত কবিতা ও কাব্যনাট্য নিয়ে পরে তিনি একটি ক্ষীণকায় কাব্যগ্রন্থ বের করেছিলেন `রসাতল ও মরিয়ম` নামে। উৎসর্গ করেছিলেন রাজশাহীরই আরেক তরুণ কবি রুবিনা আনিসকে। আশি-নব্বই দশকের তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল কবিদের সঙ্গে নিবিড় সখ্য বজায় রাখতেন তিনি। নতুনদের চিন্তাভাবনা শেয়ার করতেন। রাজশাহীর মোস্তাক রহমান, রুবিনা আনিস প্রমুখের কবিতা পছন্দ করতেন, উৎসাহ দিতেন তাদের। সমসাময়িকদের থেকে নতুন প্রজন্মের কবিদের সাথে একাত্ম হয়ে যেতে পারতেন মুস্তফা ভাই। কবি রিফাত চোধুরী, কবি কাজল শাহনেওয়াজ, অনুবাদক কবি রাজু আলাউদ্দিন, কবি সরকার মাসুদ, কবি মাসুদ খান ছিল তার খুব কাছের মানুষ। অত্যধিক স্নেহ করতে তাদের। তারাও ছিল মুস্তফা ভাই-অন্ত প্রাণ!

রোজা আসলে আমার রাজশাহী জীবন কষ্টকর হয়ে যেত। বাচ্চাদের পরীক্ষা শেষ বলে আমার পরিবার রোজার সাতদিনের মাথায় ঢাকায় চলে যেত নানাবাড়ি-দাদার বাড়ি বেড়াবে বলে। আমি যেতাম ঈদের দু-তিনদিন আগে। কষ্টটা আরও বাড়িয়ে দিতো মুস্তফা ভাই। রোজার পুরোমাসটা তিনি ঢাকায় থাকতেন গড়বেতনে ছুটি নিয়ে। এটা তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। তিনি বলতেন, রোজার দিনে তিনি অফিস করতেন না। নিয়মিত রোজা রাখতেন। আর পবিত্র কোরান শরীফের ইংরেজি অনুবাদ একটু একটু পড়ে সারা মাসে শেষ করতেন। ওই একমাস নিজের মতো করে ধর্মপালন করতেন তিনি। পবিত্র কুরআন শরীফের ইংরেজি অনুবাদের অনেক লাইন তিনি সূরা ধরে মুখস্থ বলতে পারতেন। তিনি বলতেন, থিওলজি তার একটি প্রিয় বিষয়। কুরআন ও বাইবেলের তুলনামূলক আলোচনাও তিনি করতেন অনেক আড্ডায়। সেইসঙ্গে গ্রিক প্যাগান মিথের সংমিশ্রণজাত নৈতিকতার টানাপোড়নের গল্প তার মুখে অনেক শুনেছি। সফোক্লিসের `ইলেক্ট্রা` ছিল তার প্রিয় নাটক। সাহিত্যে মিথের ভূমিকা অনেক বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। তিনি আক্ষেপ করে একদিন বলেছিলেন, বাঙালি মুসলমানের কোনো মিথ নেই, তাই কালজয়ী সাহিত্যরচনা বাঙালি মুসলমানের পক্ষে সম্ভব হয়নি।