ইসলামি চিন্তাবিদ সাইয়েদ কুতুবের আজ প্রয়াণদিবস

মিশরীয় ইসলামি চিন্তাবিদ এবং বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগঠক সাইয়েদ কুতুবের আজ প্রয়াণদিবস। মিশরের ইসলামি আন্দোলনের প্রধান সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমিন দলের মুখপত্র ‘ইখওয়ানুল মুসলিমিন`র সম্পাদক ছিলেন তিনি। তাকে তৎকালীন সরকার ফাঁসির আদেশ দেয়।

সাইয়েদ কুতুব ১৯০৬ সালের ৯ অক্টোবর মিসরের উসইউত জিলার মুশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার মূল নাম হলো সাইয়েদ, কুতুব তার বংশীয় উপাধি। তার পূর্বপুরুষরা আরব উপদ্বীপ থেকে এসে মিশরের উত্তরাঞ্চলে বসবাস শুরু করে। তার পিতার নাম হাজি ইবরাহীম কুতুব, তিনি চাষাবাদ করতেন। তার মাতার নাম ফাতিমা হোসাইন উসমান, যিনি অত্যন্ত ধার্মিক মহিলা ছিলেন।

গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাইয়েদ কুতুবের শিক্ষা শুরু হয়। মায়ের ইচ্ছানুসারে তিনি শৈশবেই কুরআন হেফজ করেন। পরবর্তীকালে তার পিতা কায়রো শহরের উপকণ্ঠে হালওয়ান নামক স্থানে বসবাস শুরু করেন। সাইয়েদ তাজহিযিয়াতু দারুল উলুম মাদ্রাসায় শিক্ষা সমাপ্ত করে কায়রোর বিখ্যাত মাদ্রাসা দারুল উলুমে ভর্তি হন। ১৯৩৩ সালে ওই মাদ্রাসা থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন এবং সেখানেই অধ্যাপক নিযুক্ত হন।

কিছুকাল অধ্যাপনা করার পর তিনি শিক্ষা মন্ত্রোণালয়ের অধীনে স্কুল ইন্সপেক্টর নিযুক্ত হন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেই তাকে আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি পড়াশুনার জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। তিনি দু’বছরের র্কোস শেষ করে বিদেশ থেকে দেশে ফিরে আসেন। আমেরিকা থাকা কালেই তিনি বস্তুবাদী সমাজের দুরবস্থা লক্ষ্য করেন এবং তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, একমাত্র ইসলামই সত্যিকার অর্থে মানব সমাজকে কল্যাণের পথে নিয়ে যেতে পারে।

আমেরিকা থেকে দেশে ফেরার পরই তিনি ইখয়ানুল মুসলেমুন দলের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি যাচাই করতে শুরু করেন। ১৯৪৫ সালে তিনি ওই দলের সদস্য হয়ে যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধ শেষে মিসরকে স্বাধীনতা দানের ওয়াদা করেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ইখওয়ান দল ব্রিটিশদের মিসর ত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এর ফলে তাদের জনপ্রিয়তা অত্যন্ত বেড়ে যায়।

১৯৫৪ সালে ইখওয়ান পরিচালিত সাময়িকী ‘ইখওয়ানুল মুসলিমুন’র সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছ’মাস পরই কর্নেল নাসেরের সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেন। কারণ, ওই বছর মিসর সরকার ব্রিটিশের সাথে নতুন করে যে চুক্তিপত্র সম্পাদন করেন, পত্রিকাটি তার সমালোচনা করে। পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার পর নাসের সরকার এ দলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন। একটি হত্যা ষড়যন্ত্র মামলার অভিযোগে ইখওয়ানুল মুসলিমুন দলকে বেআইনি ঘোষণা করে দলের নেতাদের গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতারকৃত ইখওয়ান নেতাদের মধ্যে সাইয়েদ কুতুবও ছিলেন। তাকে মিসরের বিভিন্ন জেলে রাখা হয়। গ্রেফতারের সময় তিনি ভীষণভাবে জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। সামরিক অফিসার তাকে সে অবস্থায় গ্রেফতার করে। ১৯৬৪ সালের মাঝামাঝি ইরাকের প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম আরিফ মিসর যান। তিনি সাইয়েদ কুতুবের মুক্তির সুপারিশ করায় কর্নেল নাসের তাকে মুক্তি দিয়ে তারই বাসভবনে অন্তরীণাবদ্ধ করেন।

এক বছর যেতে না যেতেই তাকে আবার বলপূর্বক ক্ষমতা দখলের চেষ্টার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। অথচ তিনি তখনও পুলিশের কড়া পাহারাধীন ছিলেন। শুধু তিনি নন, তার ভাই মুহাম্মাদ কুতুব, বোন হামিদা কুতুব ও আমিনা কুতুবসহ বিশ হাযারেরও বেশি লোককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এদের মধ্যে প্রায় সাতশো ছিলেন মহিলা।

১৯৬৫ সালে কর্নেল নাসের মস্কো সফরে থাকাকালীন বিবৃতিতে ঘোষণা করেন যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুন তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। এবং এরপর মিসরে ইখওয়ান নেতা ও কর্মীদের ব্যাপক ধরপকড় শুরু হয়। ১৯৬৪ সালের ২৬ মার্চে জারিকৃত একটি নতুন আইনের বলে প্রেসিডেন্টকে যে কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার, তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ প্রভৃতি দণ্ডবিধির অধিকার প্রদান করা হয়। তার জন্যে কোনো আদালতে প্রেসিডেন্টের গৃহীত পদক্ষেপের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা যাবে না বলেও ঘোষণা করা হয়।

কিছুকাল পর বিশেষ সামরিক আদালতে তাদের বিচার শুরু হয়। প্রথমত ঘোষণা করা হয় যে, টেলিভিশনে ওই বিচারানুষ্টানের দৃশ্য প্রচার করা হবে। কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ অপরাধ স্বীকার করতে অস্বীকার এবং তাদের প্রতি দৈহিক নির্যাতনের বিবরণ প্রকাশ করায় টেলিভিশন বন্ধ করে দেয়া হয়। তারপর রুদ্ধদার কক্ষে বিচার চলতে থাকে। আসামিদের পক্ষে কোনো উকিল ছিল না। অন্য দেশ থেকে আইনজীবীরা আসামি পক্ষ সমর্থনের আবেদন করেন। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করা হয়।

ফরাসি বার এসোসিয়েনের ভূতপূর্ব সভাপতি উইলিয়াম থরপ (Thorp) ও মরোক্কোর দুজন আইনজীবী আসামি পক্ষ সমর্থনের জন্য আবেদন করেন। কিন্তু তা না-মঞ্জুর করা হয়। সুদানের দুজন আইনজীবী কায়রো পৌঁছে সেখানকার বার এসোসিয়েশনে নাম রেজিষ্ট্রী করে আদালতে হাযির হন। পুলিশ তাদের আদালত থেকে করে দেয় এবং মিসর ত্যাগ করতে বাধ্য করে।

সাইয়েদ কুতুব ও অন্যান্য আসামি ১৯৬৬ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে বিচার চলাকালে ট্রাইবুনালের সামনে প্রকাশ করেন যে, অপরাধ স্বীকার করার জন্যে তাদের উপর অমানুষিক দৈহিক নির্যাতন চালানো হয়। ১৯৬৬ সালের আগস্ট মাসে সাইয়েদ কুতুব ও তার দুজন সাথিকে সামরিক ট্রাইবুনালের পক্ষ থেকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ শুনানো হয়। ২৫ আগস্ট, ১৯৬৬ সালে ওই দণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়।

সাইয়েদ কুতুব ছিলেন মিসরের প্রখ্যাত আলেম ও সাহিত্যকদের অন্যতম। ছোটদের জন্যে আকর্ষণীয় ভাষায় নবিদের কাহিনি লিখে তার সাহিত্যক জীবনের সূচনা। পরবর্তীকালে ‘আশওয়াক’ (কাঁটা) নামে ইসলামি ভাবধারাপুষ্ট একখানা উপন্যাস রচনা করেন। তার রচিত গ্রন্থাবলি হচ্ছে, মুশাহিদুল ক্বিয়ামাহ ফিল ক্বুরআন (কুরআনের আঁকা কেয়ামতের দৃশ্য), আত্ তাসবিরূল ফান্নি ফিল ক্বুরআন (কুরআনের আলঙ্কারিক চিত্র), আল আদালাতুল ইজতিমাঈয়া ফিল ইসলাম (ইসলামের সামাজিক সুবিচার), ফি যিলালিল কুরআন (কুরআনের ছায়াতলে), ইসলাম ও পুঁজিবাদের দ্বন্দ্ব, বিশ্বশান্তি ও ইসলাম, দারাসাতিল ইসলাম (ইসলামি রচনাবলি), ভবিষ্যৎ সংস্কৃতি, কুতুব ওয়া শাখসিয়াত (গ্রন্থাবলি ও ব্যক্তিত্ব), ইসলামি সমাজের চিত্র, আমি যে আমেরিকা দেখেছি প্রভুতি।