আরবি প্রেমের কবিতা

বাঙ্লায়ন: তুহিন খান

প্রকাশিত : নভেম্বর ২১, ২০১৯

কহলিল জিবরান

দুনিয়ার দেবতারা

প্রেমই জিতে যায়। প্রেমের শুভ্রতা, সজীবতা যেন কোনও হ্রদের তীরবর্তী দৃশ্য; আর প্রেমের সুউচ্চ মহিমা, যেন সর্বোচ্চ কোনও ভবনের ছাদ অথবা ব্যালকনি; প্রেম—একটি পদচিহ্নহীন বাগান অথবা মরুভূমি!

প্রেম আমাদের শাসক ও নিয়ন্ত্রক। প্রবৃত্তি ও আত্মার মধ্যে যুদ্ধ হলে, প্রেম বলে না খাহেশাত বিসর্জনে নির্বাণের কথা, বলে না আত্মিক কামনার বলিদানের কথা; আত্মার বিরুদ্ধে কখনও সে অস্ত্র হাতে নেয় না,—প্রেম বিদ্রোহী নয়।

প্রেম শুধু পবিত্র সমাধির প্রাচীন গন্তব্যে পৌঁছার একটি পায়ে চলা পথ রেখে যায়। যাতে সংগীত ও নৃত্যের মূর্ছনায়, এর রহস্য অমরতার পথে অগ্রসর হয়।

প্রেম বাঁধনহারা যৌবন— পুরুষকে করে আগাছামুক্ত, নারীকে উষ্ণ করে দাউদাউ আগুনে, এবং তাকে জ্যোতির্ময় করে— আমাদের বেহেশতের চেয়েও নিগূঢ় কোনও এক বেহেশতি রশ্মিতে!

প্রেম আমাদের আত্মার সুদূর থেকে ভেসে আসা উচ্ছ্ল কলহাস্য। প্রেম সেই বন্য হাওয়া, যা তোমাকে তোমার বোধের মাঝে সমাহিত করে।

পৃথিবীতে নেমে আসছে একটি নতুন ভোর।
দিন এখনও ধরা দেয়নি আমাদের চোখে। কিন্তু নিজের পরম আত্মার অভ্যন্তরে সে জেগে উঠেছে। ভাইয়েরা, দেখো আমার ভাইয়েরা— ভোরের অন্তঃস্থল থেকে বেরিয়ে আসছে নববধূ, আর সূর্যরশ্মি থেকে বর।
উপত্যকায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে শুভবিবাহ।
ধারণ করে রাখার জন্যে— একটি অসীম, অতল— দিন!
                                                                                                                                                                                                              (আংশিক)

কবি পরিচিতি: কহলিল জিবরান (১৮৮৩-১৯৩১)। লেবানিজ কবি ও লেখক। কিবদন্তি আরব কবি। `দ্য প্রফেট` বইয়ের জন্য বিখ্যাত।

আদোনিস

খালিদার জন্য আয়না

মউজ

খালিদা, আপনি
পাতার ভারে দুলতে থাকা গাছের ডাল
খালিদা, আপনি
প্রতিটা দিনরে নিজের
চোখের জলে ডুবিয়ে রাখা
এক অলৌকিক নৌ-জার্নি।
আপনি সেই মউজ
যার কাছে শেখা গেল
তারার চমক, মেঘের জমক
আর ধুলাবালির গমক—
একইরকম সুন্দর।

ডুবোপ্রেম

রাতের জলপাই পাতায় বোনা কাপড়
জড়ায়ে ঘুমাই আমরা। ধুলিমলিন রাত।
টকটকে উন্মাদনা, খোল-করতালের কোরাস— রক্তে পাই টের। ডুবোসূর্য ঢের
জলের তলায়— জ্বালে বাতি।
এই রাত হইতেছে পোয়াতি...

হারিয়ে ফেলা

আপনার বাহুডোরে একবার হারাইছি পথ। মম দুই ঠোঁট, যেনবা প্রাচীন কেল্লা, একটু পরে নত হবে। এই পরাজয়, ভালোবেসে। আরো কাছে, আপনি এখন। আপনার কোমর— বিজয়ী সুলতান। দুই হাত— সৈন্যদের বিজয়ী টহল। আপনার নয়ান— জাসুসের নিখুঁত ইশারা।

একসাথে— দোঁহে—, আগুনের দাউদাউ জঙ্গলে — আমরা হারাইয়া গেলাম। আমি— প্রথম সাহস করলাম পা বাড়ানোর; আপনি— পথ দেখাইলেন...

অবসাদ

বাড়ির ভিটায়
ঢুকে গেছে সেই
পুরান ক্লান্তি।
ড্রয়ারে এবং
ব্যালকনিতেও
ছায়া দেখি তার
ঘুমায় সেখানে
হঠাৎ— গায়েব!
এই অবসাদ
আসে ও পালায়
দুশ্চিন্তায়
কাবু হয়ে যাই
বাড়ির ভিটায়
ঘুরঘুর করি
গাছেদের কাছে
খোঁজও নিতেছি
দোয়াও করছি
যেন দেখি তারে
ডেকেছিও তারে—
কীভাবে, কোথায়,
কী? আসে বাতাস
ডালগুলি দোলে
তুমি আসলা না...

মওত

কয়েক সেকেন্ড আমাদের হিজিবিজির পর, সময় ফিরা যায় আগের জায়গায়। রাস্তা আর হাঁটার শব্দগুলা রিপিট হইতে থাকে শুধু। ঘর বলতে, থাকে খালি পুরান কাঠামো। খাটের উপরে জ্বলা পুরাতন দিনের আগুন, নিভা যায়। বিছানা-বালিশ বলতে থাকে শুধু বালিশ ও বিছানা।

এক নারীর মুখ

আমার বসবাস এক নারীর মুখাবয়বে
সে থাকে তুমুল জোয়ারে ধেয়ে আসা
পাগলা মউজের ভিতর
সে মউজ আছড়ে পড়ে
দরিয়ার জলে বন্দর হারিয়ে ফেলা
কোনও এক নিঃস্ব উপকূলে!

আমি থাকি এক নারীর মুখচ্ছদে—
যে আমারে খুন করে প্রতিদিন
যে চায় একটা মরা বিকনবাতির আলো হয়ে
আমার রক্তের উত্তাল ঢেউ পাড়ি দিয়ে
পাগলামির শেষসীমায় পৌঁছতে!

কবি পরিচিতি: আদোনিস (১৯৩০-)। আসল নাম আলি আহমদ সাইদ ইসবির। সিরিয়ান এই কবি আধুনিক আরবি কবিতার লিভিং লিজেন্ড।

নিযার কাব্বানি

যখন আমি ভালোবাসি

১.
যখন আমি ভালোবাসি
মনে হয় সময়ের আমিই মালিক
আমারই দখলে আছে দুনিয়া ও দুনিয়ার সব
অশ্বারূঢ় হয়ে আমি যাইতেছি সূর্যভ্রমণে!

২.
যখন আমি ভালোবাসি
তখন আমি হয়ে যাই অদৃশ্য
দ্রবীভূত আলো—
মম কবিতার খাতা হয়ে ওঠে
লজ্জাবতীর ঝোঁপ, পপিফুলবাগ!

৩.
যখন আমি ভালোবাসি, আমার আঙুল হয় অনন্ত এক ঝর্নাধারার উত্‍স। আমার জিহ্বায় গজিয়ে ওঠে সবুজ ঘাস। যখন আমি ভালোবাসি, পৃথিবীর সময়চেতনার বিপরীতে তখন, আমিই হয়ে উঠি এক মহাকাল!

৪.
যখন আমি কোনও নারীকে ভালোবাসি
তখন সমস্ত বৃক্ষ খালি পায়ে
আমারে আড়াল করে আগে আগে ছোটে!

কবি পরিচিতি: নিযার তৌফিক কাব্বানি (১৯২৩-১৯৯৮)। সিরিয়ান কবি ও ডিপ্লোমেট। `প্রেমের কবি` হিশাবে বিশেষ খ্যাতিমান।

মাহমুদ দারবিশ

কামসূত্রের একটি পাঠ

গাঢ় নীল পাথরের কাপ হাতে
তার অপেক্ষায় থাকো।
সন্ধ্যায়, পুষ্কুনির ধারে
জেসমিনের সুগন্ধী নিয়ে—
তার অপেক্ষায় থাকো।
পর্বতারোহণে দক্ষ অশ্বের স্থৈর্য নিয়ে
তার অপেক্ষায় থাকো।

তার অপেক্ষায় থাকো—
যুবরাজের মতো স্বতন্ত্র সৌন্দর্যবোধের
রুচি নিয়ে।
তার অপেক্ষায় থাকো
সাতটি তুলতুলে মেঘভর্তি বালিশ নিয়ে।
ধূপকাঠির মেয়েলি গন্ধে বাতাস ভরিয়ে দিয়ে—
তার অপেক্ষায় থাকো।
চন্দনের ঝাঁঝালো সুগন্ধীবেষ্টিত হয়ে
ঘোড়ার পিঠে—
তার অপেক্ষায় থাকো।

তার অপেক্ষায় থাকো এবং তাড়াহুড়া করো না।
তার আসতে দেরি হতে পারে—অপেক্ষায় থাকো।
সে তাড়াতাড়িও এসে পড়তে পারে—অপেক্ষায় থাকো।

তার দোলানো বেণীর মাঝে
লুকিয়ে থাকা পাখিদের বিব্রত করো না
অপেক্ষায় থাকো।
ফুলভরা বাগানের মতো, পরম রূপের আসনে
তারে আরামে বসতে দাও—
আর অপেক্ষায় থাকো।
তার ফুসফুসে অপরিচিত এই বাতাস
সাবধানে তারে টানতে দাও—
অপেক্ষায় থাকো।
তার পায়ের কাপড় সরাতে থাকো— আস্তে আস্তে—
আর অপেক্ষায় থাকো।

দুধেডোবা চাঁদ দেখতে তাকে বরং
ব্যালকনিতে নিয়ে যাও—
তার অপেক্ষায় থাকো।
সুরা ঢালার আগে
তারে পানি পানের প্রস্তাব দাও
তার বুকে ঘুমিয়ে থাকা তিতির পাখিদুটির দিকে তাকিও না—
অপেক্ষা করো।
এবং সে মার্বেল পাথরের ওপর গ্লাশ রাখার সময়
আলতো করে তার হাত ধরো
যেন তুমি তার জন্য বয়ে নিয়ে চলেছো একফোঁটা শিশিরের জল, অপেক্ষা করো।
তার সাথে কথা বলো
যেমন ভায়োলিনে ভীত-কম্পিত তারের সাথে
কথা বলে বাঁশি
যেন তোমরা জানতে, আগামীকাল কী ঘটতে চলেছে—
অপেক্ষায় থাকো।

রাতের প্রতিটি প্রহরষিত
তার জন্য ঝলমলে করে তোলো
আর অপেক্ষায় থাকো।
যতখন না রাতের অদৃশ্য কণ্ঠ
কানে কানে বলে যায়—
`তোমরা দুজন ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই।`

তাহলে, এবার তাকে ধীরে ধীরে নিয়ে চলো
কাঙ্ক্ষিত, প্রতীক্ষিত মৃত্যুর দিকে—
এবং অপেক্ষায় থাকো!


কবি পরিচিতি: মাহমুদ দারবিশ (১৯৪১-২০০৮)। ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি। আরব বিশ্বের প্রতিরোধ ও বিদ্রোহের অন্যতম প্রতীক।

ফুয়াদ রিফকা

শুকতারা

একদম শেষরাতে
সে এক চোখে তাকিয়ে থাকে
শুকতারাটার দিকে!
তারাটা সারারাত একা একা
জানালায় আলো জ্বাইলা রাখে
সে সারারাত একা একা
জানালা খুইলা বইসা থাকে;
দুই বন্ধু ওরা—
মাঝখানে আস্ত একটা আকাশ!

কবি পরিচিতি: ফুয়াদ রিফকা (১৯৩০-২০১১)। সিরিয়ান-লেবানিজ কবি, প্রফেসর ও অনুবাদক। পোস্টমডার্নিস্ট কবি হিশাবে খ্যাতি পাইছেন।